প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে আছে অসংখ্য বিস্ময়। তারই এক অনন্য নিদর্শন বাবুই পাখি, যার শৈল্পিক বাসা তৈরির নৈপুণ্য বিজ্ঞানীদেরও হতবাক করে। শিল্প, স্থাপত্য আর প্রেমের এক অপূর্ব মিশেলে গড়া এই পাখির জীবনকাহিনি জানতে চলুন ডুব দিই সবুজের গহিনে।
প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ স্থপতি : বাবুই পাখির বাসা শিল্পকলার এক জীবন্ত নিদর্শন। তাল, নারিকেলের ডাল, নলখাগড়া দিয়ে তারা তৈরি করে উল্টানো কলসির মতো ঝুলন্ত বাসা, যার প্রবেশপথ জটিল আঁকাবাঁকা ডিজাইনে সুরক্ষিত। বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে এ বাসা তৈরি করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছেন! বিশ্বে ১১৭ প্রজাতির বাবুই পাখির মধ্যে বাংলাদেশে মাত্র তিন প্রজাতি টিকে আছে, যারা এখন বিলুপ্তির পথে।
প্রেমের খাতিরে শিল্প : প্রকৃতির সবচেয়ে মজার প্রেমকাহিনি লেখে এই শিল্পী পাখিটি! পুরুষ বাবুই পাখি প্রকৃতির একনিষ্ঠ স্থপতি। সে একাই শুরু করে তার শৈল্পিক বাসা তৈরির কাজ। যখন বাসা অর্ধেক সম্পন্ন হয়, তখন সে গান শুরু করে মিষ্টি সুরে, প্রেমের আমন্ত্রণ জানায় তার ভাবী সঙ্গিনীকে। কিন্তু এখানে চমকপ্রদ ব্যাপার হলো-স্ত্রী বাবুই পাখি কোনো সাধারণ প্রেমিকা নয়! সে প্রথমে পুরোপুরি পরীক্ষা করে বাসার নির্মাণশৈলী, নিরাপত্তা এবং স্থায়িত্ব। সবকিছু নির্ভুল মনে হলেই সে রাজি হয় ঘর বাঁধতে।
প্রেমিকা পাখির ঘর বাঁধার আশ্বাস পেয়ে পুরুষ বাবুই আরও দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ শুরু করে। এরপরই আসে আরেক চমক, ডিম পাড়ার পরপরই এই প্রেমিক পাখি চলে যায় নতুন প্রেমের সন্ধানে, আবার নতুন বাসা তৈরি ও আমন্ত্রণ নতুন সঙ্গীকে। এক মৌসুমে সে গড়ে ছয়টি আলাদা বাসা তৈরি করে ছয়টি আলাদা সঙ্গীর সঙ্গে সংসার করে। প্রকৃতির এ নিয়মে বাবুই পাখি একদিকে যেমন বহুগামী, অন্যদিকে তার শিল্পকর্মের প্রতি এই নিষ্ঠা সত্যিই বিস্ময়কর।
এই প্রক্রিয়ায় বাবুই পাখি শেখায় কীভাবে প্রেম এবং শিল্প একাকার হয়ে যায়। তার বাসা শুধু একটি বাসস্থান নয়, এটি এক ধরনের প্রেমের প্রস্তাব, শিল্পের নিদর্শন এবং বংশবিস্তারের কৌশল, সব মিলিয়ে এক অনন্য প্রকৃতিক বিস্ময়।
প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী : গ্রীষ্মকালে বাবুই পাখির প্রজনন মৌসুম। এরা ধানের ক্ষতিকর পোকা, ফুলের মধু খেয়ে কৃষকের সহায়ক হয়। কিন্তু পরিবেশদূষণ, গাছ কাটা আর অবাধ শিকারের কারণে আজ তারা বিপন্ন। বাংলাদেশের সংবিধান ও বন্যপ্রাণী আইনে পাখি হত্যা বা শিকার করলে এক বছর কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ কম।
প্রকৃতির এই ক্ষুদ্র শিল্পী আমাদের শেখায় কীভাবে শিল্প আর প্রেম একাকার হয়। আসুন, আমরা বাবুই পাখির বাসার মতোই একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলি, যেখানে প্রতিটি প্রাণের ঠাঁই হবে সুরক্ষিত।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়