বাদুড় পৃথিবীর একমাত্র সত্যিকারের উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। এর রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০টি প্রজাতি। বাদুড় পরিবেশের জন্য অপরিহার্য প্রাণী। এরা পরাগায়ণ, বীজ ছড়ানো এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে প্রাণীটি মানব জাতির জন্য একটি বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিও তৈরি করেছে। ইবোলা, সার্স, মার্স, নিপাহ, র্যাবিস এবং কভিড-১৯ এর মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসের প্রাকৃতিক আবাসস্থল হিসেবে বাদুড় পরিচিত। বাদুড়ের দেহে ভাইরাসের সহাবস্থানের পেছনে রয়েছে তাদের অনন্য রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, উচ্চ বিপাকীয় হার এবং দলবদ্ধ বা সামাজিক বসবাসের অভ্যাস।
বাদুড়ের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে আলাদা। তাদের দেহে ইন্টারফেরন নামক প্রোটিনের মাত্রা বেশি, যা ভাইরাসের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসকে আরও বেশি বিপজ্জনক করে তোলে, কারণ ভাইরাসগুলো বাদুড়ের দেহে টিকে থাকার জন্য দ্রুত রূপান্তরিত হয়। বাদুড়ের ওড়ার জন্য প্রচুর শক্তি প্রয়োজন, যা তাদের বিপাক হার অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই উচ্চশক্তির চাহিদা ভাইরাসের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। ওড়ার সময় বাদুড়ের দেহে ডিএনএ ক্ষতি বেশি হয় কিন্তু তাদের দেহ এই ক্ষতি দ্রুত মেরামত করতে পারে, যা ভাইরাসকে দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার সুযোগ দেয়।
বাদুড় সাধারণত ২০-৩০ বছর বাঁচে এবং বৃহৎ দলে বসবাস করে। এই দীর্ঘায়ু এবং সামাজিক জীবনযাত্রা ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ ও বিবর্তনে সাহায্য করে। অস্ট্রেলিয়ার উড়ন্ত শিয়ালের মতো কিছু প্রজাতির কলোনিতে লক্ষাধিক সদস্য থাকে, যা নিপাহ বা হেন্ড্রা ভাইরাসের বিস্তারে সহায়ক। বাদুড় থেকে রোগ সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম হলো মধ্যবর্তী প্রাণী বা খাদ্য। বাংলাদেশে ২০০১ সাল থেকে নিয়মিত নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যা প্রধানত কাঁচা খেজুরের রসের মাধ্যমে ছড়ায়। বাদুড় রস খাওয়ার সময় তাদের লালা বা মূত্র রসে মিশে যায়, যা মানুষ পান করলে সংক্রমিত হয়। খেজুরের রসের হাঁড়ি জাল বা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলে এই ঝুঁকি কমানো যায়। আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস বন্যপ্রাণীর মাংস ভক্ষণের মাধ্যমে, আর অস্ট্রেলিয়ায় হেন্ড্রা ভাইরাস ঘোড়া থেকে মানবদেহে প্রবেশ করেছে।
বাদুড়ের দেহে জীবাণুর উপস্থিতি মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তবে বাদুড় নিধন কোনো সমাধান নয়, কারণ তারা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাদুড়ের প্রাকৃতিক বাসস্থান সংরক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি, অসুস্থ বা মৃত বাদুড় স্পর্শ করলে তৎক্ষণাৎ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়া, বাদুড়ের স্পর্শ করা খাবার না খাওয়া এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে বাদুড় ও মানুষের মধ্যে সমন্বয় সাধনে এড়ানো যায় ঝুঁকি। প্রকৃতি ও মানবস্বাস্থ্য উভয়ই সুরক্ষিত রাখতে এই সমন্বয় খুবই জরুরি।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়