‘মশা’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে বিরক্তিকর এক চিত্র; চুলকানি, অসহ্য গুনগুনানি এবং প্রাণঘাতী রোগের আশঙ্কা। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া কিংবা জিকার মতো রোগের জন্য দায়ী এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি যেন আমাদের জীবনের এক অবাঞ্ছিত সঙ্গী। কিন্তু প্রকৃতির মহামায়ায় সব মশাই যে ক্ষতিকর নয়, তা আমরা প্রায়ই ভুলে যাই। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় যে মশাও অবদান রাখতে পারে, তার অন্যতম প্রমাণ হলো টক্সোরিঙ্কাইটিস-এক আশ্চর্য ও উপকারী প্রজাতির মশা।
টক্সোরিঙ্কাইটিস একটি বিস্ময়কর প্রজাতির মশা, যাকে হাতি মশা বা মশা খাদক বলেও ডাকা হয়। এটি দিনে সক্রিয় এবং সাধারণত রঙিন হয়। এই মশাগুলো প্রায় পুরো পৃথিবীতেই পাওয়া যায়। টক্সোরিঙ্কাইটিসদের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মশা, যার দৈর্ঘ্য ১৮ মিমি. (০.৭১ ইঞ্চি) এবং ডানার বিস্তার প্রায় ২৪ মিমি. (০.৯৪ ইঞ্চি) পর্যন্ত হতে পারে। এটি অন্যান্য অনেক মশার মতো রক্তপিপাসু নয়। এদের প্রাপ্তবয়স্করা রক্ত না খেয়ে বিভিন্ন শর্করাবিশিষ্ট পদার্থ যেমন ফুলের মধু, ফলের রস, ক্ষতিগ্রস্ত গাছের রস ও স্যাপ, গাছের মধুরস, এমনকি পচনশীল জৈববস্তুর নির্যাস খেয়ে বেঁচে থাকে। এ ধরনের খাদ্যাভ্যাসের কারণে তারা পরাগায়ণ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। টক্সোরিঙ্কাইটিস মশা দেখতে সাধারণ মশার তুলনায় বেশ বড়। এর শরীরে নীল-সবুজ রঙের ধাতব এক আভা বিদ্যমান, যা একে সহজেই অন্যদের থেকে আলাদা করে চেনার সুযোগ দেয়। এদের লার্ভা বা শূককীট অবস্থায় এরা পরিণত হয় ভয়ংকর শিকারিতে। এরা ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক এডিস মশা এবং ম্যালেরিয়া পরজীবীর বাহক অ্যানোফিলিস মশার শূককীটদের শিকার করে খেয়ে ফেলে। ফলে এটি প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিকর মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং রোগ ছড়ানো প্রতিরোধে সরাসরি ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে পচনশীল জৈব পদার্থ ভেঙে এটি প্রাকৃতিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়ও অবদান রাখে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনসেক্ট রিয়ারিং অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন (ওজঊঝ)-এর গবেষকরা ইতোমধ্যে এই উপকারী মশার একটি স্থায়ী প্রজনন কলোনি তৈরির জন্য কাজ করছেন। গবেষণাটি সফল হলে এটি পরিবেশদূষণহীন ও টেকসই এক রোগনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পথ খুলে দেবে। এই প্রজাতির মশা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। অনেকেই এর বড় আকৃতি ও উজ্জ্বল রং দেখে আতঙ্কিত হতে পারেন। কিন্তু জানা দরকার, এই মশাটি মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিরীহ এবং উপকারী। এ ধরনের মশা দেখা গেলে ভয় না পেয়ে তাকে রক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়