প্রশান্ত মহাসাগরের নীল জলরাশির মাঝে আজ এক অদ্ভুত ও ভয়ংকর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এটি কোনো কল্পনার জগতের গল্প নয়, বরং এক নির্মম বাস্তবতা। সাগরের বুকে জমে থাকা কোটি কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য একটি বিশালাকার দ্বীপে রূপ নিয়েছে, যার আকার ফ্রান্স, জার্মানি ও স্পেনের মিলিত ভূখণ্ডের চেয়েও বড়। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন ‘গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ’। পৃথিবীর সপ্তম মহাদেশের মতোই এক ভাসমান বিপর্যয়।
প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে এক বিশেষ ধরনের স্রোত রয়েছে, যাকে বলা হয় ‘জায়ার’। এই স্রোতের ঘূর্ণন প্লাস্টিক বর্জ্যগুলোকে একত্রিত করে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে জমা করছে। দশকের পর দশক ধরে মানুষ যে প্লাস্টিক ফেলছে, তা সমুদ্রের পানিতে ভেসে এসে এই অঞ্চলে জমা হয়েছে। প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, মাছ ধরার জাল, খেলনা; এমন অসংখ্য বস্তু ছোট ছোট টুকরো হয়ে সাগরের বুকে ভাসছে।
এই প্লাস্টিক দ্বীপের আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার, যা বাংলাদেশের আয়তনের চেয়ে প্রায় ১১ গুণ বড়। এখানে জমা হয়েছে ৮০ হাজার টনেরও বেশি প্লাস্টিক। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হলো, প্রতি বছর সমুদ্রে আরও ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য যোগ হচ্ছে। যদি এই গতি অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এই প্লাস্টিকের স্তর আরও বহুগুণ বেড়ে যাবে।
এই প্লাস্টিকের স্তর শুধু সমুদ্রের সৌন্দর্য নষ্ট করছে না, বরং অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীর জীবনকে ধ্বংস করছে। কচ্ছপ, ডলফিন, সামুদ্রিক পাখি এবং নানা ধরনের মাছ প্রতিদিন খাবার ভেবে প্লাস্টিক খাচ্ছে। প্লাস্টিকের টুকরো তাদের পেটে গিয়ে আটকে যায়, ফলে তারা ধীরে ধীরে মারা যায়। কিছু প্লাস্টিক ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়ে সামুদ্রিক প্রাণীদের রক্তে মিশছে, যা তাদের দেহে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
এই বিপর্যয়ের প্রভাব শুধু সামুদ্রিক প্রাণীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণাগুলো মাছের মাধ্যমে আমাদের খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই মাইক্রোপ্লাস্টিক হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে, হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে এবং ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগের কারণও হতে পারে।
সমুদ্র আমাদের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক ফেরত দিচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে আমাদের খাবারে, পানিতে এবং পরিবেশে। এটি শুধু প্রকৃতির জন্য নয়, মানব জাতির অস্তিত্বের জন্যও এক গভীর হুমকি। এ সমস্যা সমাধানে আজই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, নইলে আগামী প্রজন্ম একটি বিষাক্ত পৃথিবীর মুখোমুখি হবে।
এ সংকট মোকাবিলায় প্রত্যেকেরই ভূমিকা রয়েছে। প্রথমেই আমাদের প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো প্রয়োজন, বিশেষ করে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক যেমন বোতল, স্ট্র, ব্যাগ, পলিথিন ইত্যাদি। প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে এবং যেখানে সম্ভব বিকল্প উপকরণ ব্যবহার করতে হবে। সমুদ্র, নদী বা পুকুরে প্লাস্টিক ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। স্থানীয়ভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কর্মশালা বা প্রচারণা চালানো যেতে পারে।
লেখক : পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়