বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটক প্রযোজনার ক্ষেত্রে যাদের নাম গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হতো তাঁদের ভিতর অন্যতম প্রযোজক ছিলেন-আবদুল্লাহ আল মামুন। মামুন ভাই ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। মেধা ও মননে ছিলেন অনন্য। তাঁর সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটকের মান কীভাবে আরও উন্নত করা যায় সেই চেষ্টা করে গেছেন তিনি। সে সময়ে স্টুডিওতে সীমিত কারিগরি সুযোগের মধ্যেও তিনি ভালো মানের নাটক বা অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছেন। আবদুল্লাহ আল মামুন ছাড়াও টেলিভিশনে অনেক প্রতিভাবান প্রযোজক ছিলেন তারাও বিটিভির সীমাবদ্ধতার ভিতর কাজ করে গেছেন। তাদের ভিতর অনেকেই আমাদের মাঝে নেই। আবদুল্লাহ আল মামুনও আমাদের ছেড়ে গেছেন ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট। আবদুল্লাহ আল মামুন অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। নিজে নাটক লিখেছেন। নাট্যরূপ দিয়েছেন। প্রযোজনাও করেছেন। রামপুরা টেলিভিশন ভবন যখন তৈরি হচ্ছে সেই অর্ধনির্মিত টেলিভিশন ভবনে ‘সংশপ্তক’ নাটকের শুটিং করা হয়েছে। তখন আউটডোর শুটিং করার কোনো সুযোগ ছিল না। তবুও আবদুল্লাহ আল মামুনের সৃজনশীলতার কারণেই নাটকটিতে আধুনিক দৃশ্যায়ন সম্ভব হয়েছিল। তাঁর হাত ধরে অনেকেই তারকা খ্যাতি পেয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে-আফজাল হোসেন, সুবর্ণা মুস্তাফা, হুমায়ুন ফরীদি, আফসানা মিমি, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, ত্রপা মজুমদার, তৌকীর আহমেদ, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াত, তানভীন সুইটি, শিরীন বকুল, দীবা নার্গিস, খায়রুল আলম সবুজ, আসাদুজ্জামান নূর, আলী যাকের, সারা যাকের, জাহিদ হাসানসহ অনেকেই।
পাকিস্তান আমলে আবদুল্লাহ আল মামুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা নামে একটি দীর্ঘ নাটক প্রযোজনা করে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন। তেমনি আধুনিক স্যাটেলাইট টেলিভিশন যুগে এসে চ্যানেল আইয়ের জন্য নির্মাণ করেছিলেন প্রতিদিনের একটি দীর্ঘ ধারাবাহিক নাটক ‘জোয়ারভাটা’। মামুন ভাই এসে যখন আমার কাছে প্রতিদিনের জন্য ডেইলি সোপ জোয়ারভাটা নাটক নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন আমি সেই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করলাম। টেলিভিশন এবং মঞ্চের অনেক কলাকুশলী প্রতিদিনের এই ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। এই ধারাবাহিকটি করতে গিয়ে মামুন ভাই ওই বয়সেও যে পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখেছেন তা ছিল আমাদের চিন্তারও বাইরে। অনেক ঘটনাবহুল ছিল সেই জোয়ারভাটার নির্মাণের গল্প। প্রতিদিনের এই ধারাবাহিক নাটকটি চলেছিল ৫০০ পর্ব পর্যন্ত।
আবদুল্লাহ আল মামুনের চলচ্চিত্রগুলো ছিল জীবনমুখী। সময়ের গল্প নিয়ে তিনি চলচ্চিত্র বানাতে পছন্দ করতেন। ষাটের দশকের জনপ্রিয় নায়িকা কবরী থেকে নব্বই দশকের পপি পর্যন্ত অনেক নায়ক নায়িকাকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তিনি। তাঁর নির্মিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘সারেং বৌ’, ‘শখী তুমি কার’, ‘এখনই সময়’, ‘জোয়ারভাটা, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ দুই জীবন ইত্যাদি।
আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত সর্বশেষ সিনেমা ‘দরিয়া পাড়ের দৌলতি’। এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণকালীন আবদুল্লাহ আল মামুন এবং চলচ্চিত্রটি মুক্তির আগে নায়ক মান্না মৃত্যুবরণ করেন। চলচ্চিত্র, নাটক-মঞ্চনাটকের মেধাবী ও সৃজনশীল এই মানুষটি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে।
আবদুল্লাহ আল মামুন ১৯৪২ সালের ১৩ জুলাই জামালপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা অধ্যক্ষ আবদুল কুদ্দুস এবং মা ফাতেমা খাতুন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে বিএ অনার্স ও এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। আবদুল্লাহ আল মামুন নিজের রচিত মৌলিক নাটকের নির্দেশনাসহ অভিনয় করেছেন। আবার তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস কৃষ্ণকান্তের উইল ও ঘরে-বাইরের নাট্যরূপ প্রদান এবং তাতে নির্দেশনাসহ করেছেন অভিনয়। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে তাঁর আরেকটি বড় অবদান হচ্ছে সৈয়দ শামসুল হক রচিত পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।