ভূমিকম্প পৃথিবীর সবচেয়ে বিধ্বংসী প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর একটি। এটি মানুষের জীবন ও সম্পদে ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু ইসলামে ভূমিকম্প কেবল একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয় না, বরং এটি আল্লাহর ক্ষমতা ও কেয়ামতের অঙ্গীকারের এক বড় আলামত হিসেবে ধরা হয়। কোরআন ও হাদিসের আলোকে ভূমিকম্পের ব্যাখ্যা এবং কেয়ামতের সময় এর গুরুত্ব অত্যন্ত স্পষ্ট।
কোরআনে কেয়ামতের শুরুতে ভূমিকম্পের বর্ণনা এসেছে। বিশেষভাবে সুরা হজ এ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর। নিঃসন্দেহে কেয়ামতের ভূমিকম্প এক মহাভয়াবহ বিষয়।’ যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, সেদিন প্রত্যেক দুগ্ধদানকারী নারী তার দুধের শিশুকে ভুলে যাবে এবং গর্ভবতী নারী গর্ভপাত করবে; মানুষকে মাতাল মনে হবে, অথচ তারা মাতাল নয়।’ (সুরা আল হজ-১, ২)
এই আয়াতে আল্লাহ কেয়ামতের প্রথম ভীতিকর ঘটনা হিসেবে ভূমিকম্পের কথা উল্লেখ করেছেন, যা সমস্ত সৃষ্টিকে প্রবল আতঙ্কে ফেলে দেবে। এই ভূমিকম্পের সময় পৃথিবী এবং আকাশের সব দৃশ্য বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। কেয়ামতের আগমনের সঙ্গে পৃথিবীর সবকিছু পাল্টে যাবে এবং মানুষ সম্পূর্ণভাবে বিচলিত হয়ে পড়বে। এ ছাড়া সুরা যিলযাল-এ পৃথিবীর ভয়াবহ ভূমিকম্পের বর্ণনা রয়েছে, ‘যখন পৃথিবী তার ভারী কম্পনে কেঁপে উঠবে। এবং পৃথিবী তার বোঝা (সমাহিত বস্তু) বের করে দেবে।’ (সুরা যিলযাল-১-২)। এটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে কেয়ামতের দিনে পৃথিবী তার সব ভারী বোঝা (মৃতদেহ, ধনসম্পদ, সব গোপন বিষয়) বের করে দেবে। পৃথিবী নিজেকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করবে।
হাদিসে ভূমিকম্পের বর্ণনা : হাদিসে ভূমিকম্প কেয়ামতের ছোট আলামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সহিহ বুখারিতে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাবে।’ (সহিহ বুখারি, কিতাবুল ফিতান)
এখানে রসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্টভাবে বলেছেন যে কেয়ামতের আগমনের প্রাথমিক সূচনা হবে ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে। পরবর্তী সময়গুলোতে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপকতা ও ঘনত্ব বৃদ্ধি পাবে। ভূমিকম্পের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কেয়ামতের দূরত্বও কমে আসবে। এ ছাড়া রসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যখন তোমরা ভূমিকম্প দেখতে পাবে, তখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।’ (সহিহ বুখারি)
এটি দেখিয়ে দেয় যে ভূমিকম্প শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এটি মানুষের জন্য একটি সতর্কবাণী এবং আল্লাহর কাছে তওবা করার সুযোগ। ভূমিকম্পের সময় মানুষ যেন তওবা করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
ভূমিকম্পের কারণ এবং উদ্দেশ্য : ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ভূমিকম্পের মূল কারণ হলো আল্লাহর ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত। পৃথিবীতে যখন মানুষের মধ্যে পাপ, দুর্নীতি, অস্থিরতা এবং অশান্তি বৃদ্ধি পায়, তখন আল্লাহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও ক্ষমতার প্রকাশ ঘটান। অনেক সময় ভূমিকম্প আল্লাহর শাস্তি হতে পারে, আবার কখনো এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য একটি পরীক্ষা হিসেবে আসতে পারে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যখন আল্লাহ বান্দাদের শাস্তি দেন, তখন পৃথিবী কেঁপে ওঠে। কিন্তু যখন বান্দারা তওবা করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন সেই শাস্তি প্রশমিত হয়।’ (সহিহ মুসলিম)
এই হাদিসের মাধ্যমে এটি পরিষ্কার যে, ভূমিকম্প এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ আল্লাহর রহমত এবং শাস্তির প্রকাশ হতে পারে, যা মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি অধিক আনুগত্য ও প্রীতি গড়ে তোলে।
ভূমিকম্প এবং কেয়ামত : ভূমিকম্প কেয়ামতের আলামত এবং আল্লাহর শাস্তির একটি চিহ্ন। আমাদের উচিত এর মাধ্যমে নিজেদের সতর্ক করা, তওবা করা এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। প্রতিটি ভূমিকম্পের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মনে রাখা উচিত যে এটি একটি মহান শিক্ষা এবং সংকেত যে কেয়ামত একদিন অবশ্যই আসবে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যতক্ষণ না কেয়ামত আসবে, পৃথিবী কেঁপে উঠবে, কিন্তু যখন কেয়ামত আসবে, পৃথিবী এবং আকাশ সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হবে।’ (সহিহ মুসলিম)
এই হাদিসটি কেয়ামতের দুর্বিষহ দৃশ্যের কথা ইঙ্গিত করে, যা আল্লাহ প্রদত্ত সৃষ্টির পরিবর্তনের মাধ্যমে স্পষ্ট হবে। তাই আমাদের উচিত জীবনকে সৎ ও নৈতিক পথে পরিচালিত করা এবং কেয়ামতের প্রস্তুতি হিসেবে নিয়মিত তওবা, দোয়া এবং নেক কাজের দিকে মনোনিবেশ করা। ভূমিকম্প কেবল একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এটি কেয়ামতের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলামত এবং আল্লাহর শক্তি ও শাস্তির এক পরিচায়ক। কোরআন ও হাদিসের আলোকে আমরা বুঝতে পারি যে ভূমিকম্পের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের সতর্ক করে দেন এবং আমাদের সঠিক পথে চলার নির্দেশনা দেন। আমাদের উচিত এসব দুর্যোগকে একটি পরীক্ষারূপে গ্রহণ করে আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা