ভ্রমণকালের দেখাশোনায় থাকে আনন্দ-বেদনার ছাপ। এতে কিছু কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে তৈরি হয় দৃষ্টির আনন্দ আর চিন্তার সুখ। ওই সময়টায় আমার সঙ্গে এমন সব মানুষের আলাপ-পরিচয় হয়, যাঁদের চেহারা ও মন্তব্য শতচেষ্টায়ও ভুলে যাওয়া অসম্ভব। ১৯৯২ সালের নভেম্বরে সপরিবার যাচ্ছিলাম হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির দরগাহে। হাওড়া স্টেশনে ‘কালকা মেইল’ ট্রেনে চেপেছি। দিল্লিতে নেমে আরেকটি ট্রেনে উঠতে হবে আজমির যাওয়ার জন্য। কালকা মেইলের ভিতর দুই ব্যক্তির দেখা পাই। যাঁরা আমার হৃদয়মাঝে ভাস্বর জ্যোতি হয়ে রইবেন চিরকাল।
চল্লিশ-ঊর্ধ্ব সমবয়সি প্রকৌশলী প্রাণেশ সাকসেনা ও ডা. ওয়াসি আহমেদ আসন পেয়েছেন আমাদের ট্রেনকামরায়। প্রাণেশের পিত্রালয় হরিয়ানায়, ওয়াসির বাড়ি পুরানা দিল্লিতে। ‘আই সুইট বাবু! হোয়াটস ইয়োর নেম?’ প্রশ্ন করেন প্রাণেশ। পঞ্চম শ্রেণিতে সদ্য উন্নীত ছেলে নিয়াব ওয়াহেদ পুলক, যথাযথ উত্তর দিলে তিনি একটি পলিব্যাগে হাত ঢোকাতে ঢোকাতে বলেন, ‘নাইস নেম। লাও, এলাহাবাদি জামরুদ খাও। বহুত মজাদার।’
হিন্দিতে জামরুদ, বাংলায় পেয়ারা। এলাহাবাদের পেয়ারা দেখতে ছোটখাটো ফুটবল। বিচি খুবই কম এবং এতই সুস্বাদু যে খেয়ে আশ মিটতে চায় না। পুলকের বাবা-মা আর ডা. ওয়াসিকেও জামরুদ খেতে দিলেন প্রাণেশ সাকসেনা। দেখি, পলিব্যাগে রয়েছে একটি মাত্র পেয়ারা। ওয়াসি বলেন, ‘ও রাখ্ দিয়া কিউ? খা লিজিয়ে।’ প্রাণেশের উত্তর : পুলকবাবু ফির মাঙ্গে তো ক্যায়সে দি লাউ? (পুলক আবার পেয়ারা খেতে চাইলে কোথা থেকে দেব?) ‘ফিক্র মত ফিজিয়ে।’ বলেন, ডা. ওয়াসি, ‘জো মুঝে মিলা ওহ জামরুদ ম্যায় পুলক সাহাব কো তোহফা কর দেঙ্গে।’ (সেজন্য ভাববেন না। যে পেয়ারা আমায় দিলেন, সেটা আমি পুলক সাহেবকে উপহার দেব)। ওয়াসি তাঁর হাতে রাখা পেয়ারাটি সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দেন পুলকের মায়ের দিকে, ‘লিজিয়ে ভাবি সাহাব, আপনা বেটা লিয়ে ইসকো রিজার্ভ রাখ্খিয়ে।’
পুলকের মা বলেন, না। না। আপনি খান। পথে ট্রেন থামলে ছেলের জন্য পেয়ারা কেনা যাবে। ওয়াসি বলেন, হ্যাঁ। কেনা হয়তো যাবে। তবে এলাহাবাদি পাবেন, এমন গ্যারান্টি নেই। প্রাণেশ বলেন, ‘ডাক্তার ঠিকই বলেছেন, নো গ্যারান্টি।’ একটি মাত্র পেয়ারাসমেত হলুদ রঙের পলিব্যাগটি এগিয়ে ধরে প্রাণেশ বলেন, ভাবিজি, দোনো জামরুদ ইসমে রাখ দিজিয়ে প্লিজ!
ট্রেনে চেপেছি রবিবার রাত ১০টায়। ট্রেন দিল্লি স্টেশনে ঢুকবে সোমবার রাত ৯টায়। কাজেই দুই ভারতীয় সহযাত্রীর সঙ্গে আড্ডাবাজি ধরনের পরিবেশ গড়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ওয়াসি জানান, তিনি পশু ডাক্তার। ডিগ্রি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে লিবিয়ায় চাকরি পেয়ে যান। সে দেশে তিন বছর ছিলেন। ইন্ডিয়ান, শ্রীলঙ্কান, ইন্দোনেশিয়ান আর বাংলাদেশি মিলে ২০ জন পশু ডাক্তার বিরাট এক সরকারি বাসভবনে বাস করতেন। ওয়াসি তখন ব্যাচেলর। অন্য ডাক্তাররা সপরিবার বাস করতেন। চার কামরার ফ্ল্যাটে ওয়াসি একা। তাঁকে আগলে রেখেছিল বাংলাদেশি তিন ডাক্তারের পরিবার। এক দিনের জন্যও তাঁকে হোটেলে খেতে হয়নি। ওই তিন বাঙালি ১০৯৫ দিন পালাক্রমে দিল্লিওয়ালা ওয়াসি আহমেদকে দুই বেলা অন্ন জুগিয়েছেন। ওয়াসি বলেন : ভাই, বাংলাদেশের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার সীমা নেই।
২. প্রাণেশ সাকসেনা বছরে একবার আজমিরে গিয়ে খাজাবাবাকে প্রণাম করে থাকেন। তিনি বলেন, খাজার প্রতি সব ধর্মের মানুষের গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও নিবেদন দেখে আমরা মুগ্ধ হই। এই সুযোগে মতলববাজ কিছু লোক খাজাবাবার অলৌকিক ক্ষমতার কেচ্ছা শোনায়। শ্রোতারা ভুলে যান যে সাধকপুরুষরা যে ধর্মেরই অনুসারী হন না কেন তাঁরা অবশ্যই অসাধারণ, কিন্তু তাঁদের মধ্যে সবার অন্তরে ঠাঁই পেয়ে ভুবনখ্যাত অত্যল্প কয়েকজন। বঞ্চিতের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিরামহীন সংগ্রাম করেছেন বলেই তাঁরা শতকের পর শতক স্মরণীয়। অযৌক্তিক ঐশ্বরিক শক্তি ও বানোয়াট কাহিনি দিয়ে তাঁদের অমর করবার চেষ্টা হাস্যকর। ফসলের উৎপাদক কৃষক। ফসল হবে পাঁচ ভাগ। এর এক ভাগ কৃষকের। চার ভাগ পাবে রাজা। কেন? জমির মালিক যে রাজা। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি বললেন, জমির মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। রাজা হচ্ছেন জমির তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। তাই ফসলের ভাগ তত্ত্বাবধায়কেরও প্রাপ্য। খাজা বাবার বিধান : ফসল হবে তিন
ভাগ। দুই ভাগ কৃষকের এক ভাগ তত্ত্বাবধায়ক অর্থাৎ রাজার।
বিধানটি সাধারণ কৃষক-অকৃষক সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়। আওয়াজ তোলে ‘তিন ভাগের দুই ভাগ আমাদের। এ ধরনের আর্থিক স্বার্থবোধই দুনিয়ার নানা প্রান্তে রিক্ত-নিঃস্ব জনতার বুকে আগুন জ্বালায়। আজমিরেও আগুন জ্বলে ওঠে। প্রাণেশ সাকসেনা বলেন, খাজাবাবা নিঃস্ব-রিক্তদের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধ করেন অত্যাচারী রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে এবং জয়ী হন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে দেখি আলো ঢেকে রাখা হচ্ছে ধোঁয়ার বড়াই দিয়ে। ন্যায়ের পক্ষের জাগরণের সংবাদ চেপে রেখে প্রচার করা হচ্ছে গড়িয়ে পড়া প্রকাণ্ড প্রস্তরখণ্ড লাঠির ডগা দিয়ে রুখে দেওয়ার কাহিনি।
‘তোমাদের দেশে পাকিস্তানি জমানায় তেভাগা আন্দোলন হয়েছিল জানো তো!’ বলেন, প্রাণেশ সাকসেনা, ‘ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এক জমিদারের পুত্রবধূ, নাম ইলা মিত্র। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির ফর্মুলা অনুসরণ করেই তিনি ওই আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন কিনা গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।’
রাত দেড়টা পর্যন্ত প্রাণেশ, ওয়াসি আর আমি নানা বিষয়ে মতবিনিময় করি। সকালে নাশতা সেরে আবার সংলাপ। একপর্যায়ে হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে প্রাণেশ বলেন, খাজাবাবাকে সালাম জানিয়ে ফেরার পথে আমাদের বাড়ি এসো। বিস্তর কমলা হয় আমাদের। এসো, পানি খাওয়ার স্টাইলে গ্লাসের পর গ্লাস জুস খেয়ো। ড্রিংক অ্যান্ড ড্রিংক টিল দ্য স্টমাক রিভোল্ট।
৩. মেহমানের ঘনঘন আগমনে গৃহস্থের বিরক্তি ধরলে দোষ দেওয়া ঠিক না। বেগম ওয়াসি আহমেদের ব্যাপার উল্টো। কমপক্ষে এক মাস অন্তর মেহমান না এলে এই মহিলার মনটা খচখচ করে। আল্লাহ কি কোনো কারণে নারাজ হলেন? নইলে উনি মেহমান পাঠাচ্ছেন না কেন! ডা. ওয়াসি বলেন, আরে তুমি হলে গিয়ে মুসলিম ফ্যামিলির কন্যা। তুমি ‘অতিথি নারায়ণ’ রীতিতে অবস্থা বিবেচনা কর, এটা জানাজানি হয়ে গেলে কৈফিয়তে কী বলবে?
‘তোমাদের দেখলে সাবরিনা কী যে খুশি হবে। বিশেষত তোমরা বাংলাদেশি। তোমরা তিন তিনটি বছর ওর স্বামীকে মুফতে আহার জুগিয়েছ। তোমাদের সেবা করার সুযোগ মানে তার ওপর আল্লাহর বিরাট মেহেরবানি’ বলেন ডা. ওয়াসি, ‘তাই, দিল্লিতে নেমে তোমরা সোজা আমার বাড়ি যাচ্ছ। খেয়েদেয়ে রেস্ট নিচ্ছ। আর রাত সাড়ে ১১টায় ফের স্টেশনে এসে আজমিরগামী ট্রেনে উঠবে। আমি আর সাবরিনা এসে তোমাদের ট্রেনে উঠিয়ে দেব।’
পরিকল্পনা ও ঘোষণা পরিষ্কার। কিন্তু ট্রেনের সূচিতে গন্ডগোল। কালকা মেইল দিল্লি স্টেশনে পৌঁছায় নির্ধারিত সময়ের দুই ঘণ্টা পর, রাতে ১১টা ৫ মিনিটে। ট্রেনের তাপানুকূল কামরা থেকে প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই নভেম্বরের প্রচণ্ড শীতের কামড়। মনে হলো কোমরের নিচে শরীরের কোনো অঙ্গ নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম দ্রুত আজমির পৌঁছতে বাসে রওনা দেব। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ তা-ই কর। নইলে পুলকের ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।’ বলেন ওয়াসি। আজমিরগামী ট্রেনের টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে এলেন তিনি। তারপর ট্যাক্সি ডেকে আন্তঃপ্রদেশ বাস টার্মিনালে নিয়ে গেলেন আমাদের। প্যাকেট করা খাবার কিনে দিলেন তিনজনকে। প্যাকেটে সাদা ভাত, মুরগির গোশত আর সবজি।
একটা কাগজে বাড়ির নম্বর আর মহল্লার নাম লিখে আমার হাতে দিয়ে বলেন, ‘ফোন নম্বরও লিখে দিলাম। ফেরার পথে আমার এখানে কমসে কম তিন দিন থেকে যেও। পুলককে আমি দিল্লির ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো একটা একটা করে দেখাব। দেখে আনন্দ পাবে। ফাদার মাদার ওর কোম্পানি দিলে ওয়াসি অ্যান্ড সাবরিনা হ্যাভ নো রাইট টু লজ দেয়ার অবজেকশন ওভার ইট।’ ফেরার পথে ডা. ওয়াসির আতিথ্য গ্রহণ সম্ভব হয়নি। সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করে তাঁকে চিঠি দিই। উত্তরে তিনি লিখেছেন, আমি প্রতিশোধপরায়ণ প্রাণী। সস্ত্রীক ঢাকায় এসে তোমার মেহমান হব। অ্যান্ড উইল স্টে য়্যাট ইয়োর প্লেস ফর আ লং টাইম টু সি দ্যাট বোরনেস ইটেন আপ ইয়োর বোন অ্যান্ড ম্যারো। ওয়াসি ঢাকায় আসেননি। হয়তো আসার চেষ্টা করতেন, যদি বেঁচে থাকতেন। করোনায় ভুগে মারা গেছেন ডা. ওয়াসি। স্বামীর মৃত্যুর বারো দিন পর দুনিয়া ছেড়ে গেছেন সাবরিনা। তাঁকেও শেষ করেছে করোনা। চমৎকার একটা তথ্য আমায় দিয়েছিলেন ওয়াসি। এজন্য তাঁর কাছে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।
৪. আল্লাহকে হত্যা করার জন্য নমরুদ স্বর্গে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করে। কিন্তু যাবে কীভাবে? একটা মঞ্চ বানায় সে। মঞ্চের চার কোণে চারটি ঈগল। মঞ্চে চেপে আকাশে ওঠে নমরুদ। স্বর্গের দিকে তির ছোড়ে। ফিরে আসে তির। তিরে রক্তের দাগ। নমরুদ মহাখুশি। মনে করে আল্লাহ তিরবিদ্ধ হয়েছেন। খুশিতে যখন সে আত্মহারা, ঠিক তখনই তার নাকে ঢুকে পড়ে একটি মশা। ডা. ওয়াসি আহমেদ জানান, সেই যে ঢুকল আর বের হয় না। সে যেতে যেতে মাথার মগজে পৌঁছে এবং অবিরাম কামড়াতে থাকে। যন্ত্রণায় অস্থির নমরুদ হাতুড়ি দিয়ে মাথায় ঘা মারে। চার শ বছর ধরে মশাটি মগজ কামড়িয়েছে।
নমরুদের আদি নাম নমরা। তার বাবা কান আন ইবনে কুশ স্বপ্নে দেখে যে ছেলের হাতে সে খুন হয়েছে। তাই জন্মের পরই ছেলেকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় কান। কানের স্ত্রী সুলখা শিশুসন্তানকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তাকে গোপনে ভেড়ার পালের মধ্যে রেখে আসে। কুশ্রী চেহারার শিশুটি দেখে ভয়ার্ত হয় মেষপালকের বউ। সে শিশুটিকে ছুড়ে ফেলে নদীতে। ভাসতে ভাসতে পরিত্যক্ত শিশু পৌঁছে যায় জঙ্গলে। সেখানে এক বাঘিনীর দুধ খেয়ে বেড়ে ওঠে এবং একসময় ডাকাত সর্দার হয়। আরবিতে বাঘিনীকে বলা হয় ‘নমরা’। কালক্রমে ‘নমরুদ’ নামে তার কুখ্যাতি।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন