আমার বন্ধুদের মধ্যে বেশির ভাগই রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। মাধ্যমিক স্তর থেকে রাজনীতি করলেও স্কুল-কলেজের রাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। যার মূল কারণ আমার সেসব বন্ধু পরবর্তী সময়ে রাজনীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি এবং বেশির ভাগই অন্য শ্রেণি-পেশায় হারিয়ে গেছে। অনেকে জীবনযুদ্ধে পরাজিত, কেউ কেউ ধরাধাম থেকে বিদায় হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধু যাদের অনেকেই ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী ছিল তারা জীবনজীবিকা, রাজনীতি, শিল্পসাহিত্যসহ আমলাতন্ত্রে এতটাই সফল হয়েছে যা ছাত্রজীবনে আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারিনি। ফলে কোনো মায়া-আড্ডায় আমরা যখন মিলিত হই তখন অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে যে উদ্দীপনা লাভ করি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।
আমার যে বন্ধুটি কলেজজীবনে একটি মেয়ের প্রেমের প্রত্যাশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইডেন কলেজের সামনে লেফট রাইট করত সে এখন জীবনের সফলতার কারণে বহু রমণীর ক্রাসে পরিণত হয়েছে। যে বন্ধুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে হলের সিট না পেয়ে মসজিদে ঘুমাত এবং একটি সিটের জন্য নেতাদের তোয়াজতদবির ফুটফরমাশ খাটত সে পরবর্তীকালে মন্ত্রী-এমপি হয়ে দেহরক্ষী নিয়ে এমনভাবে চলাফেরা করত যা দেখে মনে হতো ও বোধ হয় জন্মজন্মান্তরে রায়বাহাদুর খানবাহাদুরনন্দন ছিল।
ব্যবসায়ী হিসেবে যারা সফল হয়েছে তারা প্রায় সবাই গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। কেউ কেউ বড়জোর নিম্নবিত্ত- যাদের পিতামাতা দুই-তিন মাস পর বহু কষ্টে হাজারখানেক টাকা পাঠাতে পারতেন। আমার এসব বন্ধু একটি টিউশনি, একটি লজিং কিংবা পার্টটাইম টুকটাক ব্যবসা অথবা চাকরি করতে গিয়ে যে মেহনত করেছে তার ফলে বিধাতা তার অপার মহিমায় সহায়সম্পদ দিয়ে এতটা ধনবান করেছেন যা দেখলে আমি নিজের অজান্তে বলে উঠি এ-ও কি সম্ভব! ১৯৮২ সালে ঢাকায় পড়তে আসা দরিদ্র ঘরের মেধাবী সন্তানটি সফলভাবে পড়াশোনা করেছে এবং ছাত্রাবস্থায় ব্যবসাবাণিজ্য করে এমন সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে যেখানে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠীদের মধ্যে অনেক ধনীর দুলাল-দুলালী ছিল। নামকরা আমলা-কামলা, বিচারপতি-রাষ্ট্রপতির নন্দনরাও ছিল। কবি-সাহিত্যিক, জমিদার, নবাব বংশের ছেলেমেয়েরাও পড়তে আসত। কারণ তখনো দেশে ব্রেইন-ড্রেইন শুরু হয়নি এবং দেশের মধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কালচার গড়ে ওঠেনি। এসব ধনীর দুলাল সাধারণত গেঁয়োদের সঙ্গে চলত না। অন্যদিকে গেঁয়োরা প্রথমে জেলাভিত্তিক, তারপর বিভাগওয়ারি এবং সর্বশেষ মেধা অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে চলাফেরা করত। গেঁয়োদের একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে জড়াত- কেউ কেউ অস্ত্রবাজি, গুন্ডামি, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতেও বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিল। আমাদের জমানায় কেন জানি গুন্ডাদের প্রতি সবার তীব্র আকর্ষণ ছিল। এমনকি মেয়েরাও গুন্ডা ছেলেদের পছন্দ করত। দ্বিতীয়ত যাদের কাব্য প্রতিভা ছিল এবং সুবক্তা হিসেবে মঞ্চ কাঁপাতে পারত তারাও কম আকর্ষণীয় ছিল না। .jpg)
আমি বালকবেলা থেকে রোগা, শারীরিকভাবে দুর্বল এবং ভীরু ও লাজুক প্রকৃতির। আমার খুব ইচ্ছা হতো গুন্ডা হওয়ার জন্য। কিন্তু গুন্ডামির কথা শুনলে আমার হাত-পা কাঁপত। এমনকি ভয়ে আমি আমার গুন্ডাবন্ধুদের সঙ্গেও ঠিকমতো কথা বলতে পারতাম না। প্রেমের জন্য আমার দিল সব সময় ধকধক করত। কিন্তু মেয়েদের দেখলে আমার হাত-পা অবশ হয়ে যেত। শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যেত। জবান বন্ধ হয়ে কপাল দিয়ে দরদর করে ঘাম বের হতো। ফলে প্রেম করার ইচ্ছা পরানের গহিনে দুমড়েমুচড়ে ছাতু হতো। আমার এই দুর্বলতার কারণে মাঝেমধ্যে বৈরাগী হতে চাইতাম আবার কখনো কখনো মেয়েদের প্রতি ভীষণ রাগ হতো- কেন ওরা আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেয় না।
কলেজ ছাত্রাবাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কিংবা ছাত্রদের মেসে প্রায়ই ভীষণ আড্ডা হতো। গুন্ডারা নিজেদের বাহাদুরির গল্প শোনাত। প্রেমিক পুরুষরা প্রেয়সীর প্রেমপত্র পড়ে শোনাত আর আমার মতো হাঁদারাম অবাক বিস্ময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওসব গল্প শুনে বেঁচে থাকার পুলক অনুভব করতাম। কথার ফাঁকে নিজেদের অভাব অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হতো, বিশেষ করে অভাবী ছাত্ররা একটি টিউশনির জন্য বন্ধুদের কাছে অনুনয়-বিনয় করত। আমার মতো যেসব বন্ধুর ঢাকা শহরে বহু আত্মীয়স্বজন ছিল তারা খুব সহজেই টিউশনি জোগাড় করে দেওয়ার কাজটি করতে পারত এবং তারা সবাই নিঃস্বার্থভাবে সেই কাজটি করত।
উল্লিখিত ঘটনার পর কীভাবে যে ৪৩ বছর পার হয়ে গেছে তা নিয়ে ভাবলে হঠাৎ বুকের মধ্যে হাহাকার শুরু হয়ে যায়। অথচ করোনার আগেও আমি এবং আমার বন্ধুরা বহু বছর বেঁচে থাকতে চাইতাম। জীবনযুদ্ধের প্রতিটি বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতাম এবং একে অপরকে সহযোগিতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতাম। অবসরে আমরা আড্ডা দিতাম। কখনো বন্ধুদের বাসায় আবার কখনো পাঁচতারকা হোটেলে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই আমরা ছাত্রজীবনের স্মৃতিবিজড়িত সাধারণ হোটেলগুলোতে গিয়ে আড্ডা দিয়ে অসাধারণ আনন্দ উপভোগ করতাম। আমাদের এই সুদীর্ঘকালের বন্ধুত্ব এবং জীবনের ছন্দময় গতি হঠাৎ থেমে যায় করোনাকালীন। করোনার ভয়-আতঙ্ক আমাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আমাদের পারিবারিক মায়াদয়া-মমত্ববোধ-দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের যে ঐতিহ্য ছিল তা পচে গলে দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়ে। ঘরের মধ্যে পিতা-মাতা কিংবা সন্তান করোনায় আক্রান্ত! আমরা কেউ কাছে যাচ্ছি না। হাসপাতালে প্রিয়জন মারা গেল আমরা ঘরে বসে কাঁদলাম কিন্তু লাশ গ্রহণ ও দাফনকাফনের ভার দিলাম স্বেচ্ছাসেবীদের হাতে।
করোনাকালে আমাদের ব্যবসাবাণিজ্যে যে সংকট শুরু হলো তার দুর্যোগ-দুর্দশা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবে। অনেকে দেউলিয়া হয়ে পড়ল। যারা টিকে রইল তাদের অবস্থাও আইসিইউতে থাকা করোনা রোগীদের মতো হলো। স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার অবস্থা রইল না। ব্যবসাবাণিজ্যের এমনতর মুমূর্ষু অবস্থায় ব্যাংক-বিমা, কাস্টমস, আয়কর বিভাগের দুর্নীতিবাজরা আজরাইলের মতো ব্যবসায়ীদের শ্বাসনালি চেপে ধরল। ব্যবসায়ীরা যে চিৎকার করবে, সাহায্য চাইবে কিংবা আত্মহত্যা করবে সেই পরিস্থিতি রইল না। এই অবস্থায় আমার সফল বন্ধুদের মরণকান্না শুরু হলো। আমরা পরস্পরকে ফোন করে ইতঃপূর্বে যে মৌজমাস্তি করেছি তার প্রাকৃতিক প্রতিশোধের কবলে পড়ে করোনার সময় আমরা প্রাণভরে, কলিজাভরে কান্নাকাটি-আহাজারি করে বেঁচে থাকার নির্মম অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলাম।
করোনা নিয়ে আজকের দুনিয়ায় বিস্তর গবেষণা হচ্ছে। বেশির ভাগ গবেষণার ফল হলো- করোনা ছিল মানবসৃষ্ট পৃথিবীর সর্বকালের ভয়াবহতম করপোরেট জালিয়াতি, প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যের কালো জগতের গডফাদাররা মানুষকে ভয় দেখিয়ে যে পরিমাণ মুনাফা করেছে এবং নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য তামাম দুনিয়ার জীবনজীবিকা, প্রকৃতি পরিবেশ এবং সমাজসংসারের নৈতিক মূল্যবোধ তছনছ করেছে তা স্বাভাবিক করতে মানবজাতিকে আরও অর্ধশতাব্দী লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে।
পৃথিবীর সব দেশই করোনা দ্বারা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ সীমাহীন। করোনা-পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মহামারি এবং সামাজিক অবক্ষয় আমাদের তছনছ করে দিয়েছে। আমরা যেভাবে সর্বনাশের বুলেট ট্রেনে দুর্দান্ত গতিতে ধ্বংসের অতলান্তে যাত্রা করেছিলাম তা গত এক বছরে রীতিমতো সুপারসনিকের গতি লাভ করেছে। অর্থাৎ আমাদের চলমান অধঃপতনের গতি শব্দের গতির চেয়ে বেশি। যারা এই ধরনের সুপারসনিক বাহনে (কনকর্ড বিমান) চড়েছেন তারা জানেন সুপারসনিকের যাত্রীদের মস্তিষ্ক রক্ত সঞ্চালন পরিপাকতন্ত্রের ওপর কী পরিমাণ চাপ পড়ে। আমরাও চলমান সংকটে আক্রান্ত হয়ে রীতিমতো দিশাহারা, নির্বোধ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতিতে পরিণত হয়েছি। অভাব-অভিযোগ সংকট-সমস্যা এবং দৈনন্দিন সন্ত্রাস-আতঙ্ক আমাদের চিন্তাশক্তিকে শেষ করে দিচ্ছে। সুখানুভূতি, সুখের স্মৃতির রোমন্থন এবং প্রিয়জনের সান্নিধ্য আবার আকাঙ্খাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। ফলে গত এক বছরে আমার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রা কমতে কমতে আজ প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছেছে। ফলে আমি বেঁচে আছি সত্য- কিন্তু আমার পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেমন আছে তা আমি জানি না। আমার জীবনযুদ্ধ আমাকে এমন এক অথই সাগরে ফেলে দিয়েছে সেখানে কেবল নাকটি ভাসিয়ে রেখে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া ছাড়া আমার অন্য কোনো স্বপ্ন-স্বাদ-আহ্লাদ নেই।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক