প্রতিদিন পৃথিবীর কত না সড়কে থেমে যাচ্ছে হাজারো জীবন। নীরবে ঘটে যাচ্ছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়, যেন এক চলমান মহামারি। যে বিপর্যয়ে হারিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন, ভেঙে পড়ছে পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, প্রতি বছর রোডক্র্যাশে প্রাণ হারায় প্রায় ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ। আহত হয় কয়েক কোটি, যাদের অনেকেই চিরজীবন পঙ্গুত্ব বয়ে বেড়ায়। এমন দুর্ঘটনায় বেশির ভাগ দেশের অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ৩ থেকে ৫ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হয়, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ভয়াবহ বোঝা।
বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক চিত্র থেকে ব্যতিক্রম নয়। দেশে প্রতি বছর গড়ে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়, আহত হয় এর কয়েক গুণ বেশি। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, এসব দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশই ঘটে অতিরিক্ত গতি ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে। এতে শুধু প্রাণহানি নয়, পরিবার ও জাতির অর্থনীতিও মারাত্মক ক্ষতি হয়। ব্র্যাক ইনজুরি রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ৫ থেকে ২ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় প্রতি বছর, যা শিক্ষা বা স্বাস্থ্য খাতে বড় বাজেট ঘাটতি পূরণে কাজে লাগানো যেত। এই প্রেক্ষাপটে ২২ অক্টোবর নবমবারের মতো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি বাস্তবভিত্তিক ও সময়োপযোগী। কারণ সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই দুটি বিষয়ই বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে কার্যকর বলে প্রমাণিত।
মানসম্মত হেলমেট কেন জরুরি?
মোটরসাইকেল এখন শহর ও গ্রাম উভয় জায়গায় অন্যতম প্রধান চলাচলের বাহন। কিন্তু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে, দেশে মোট রোডক্র্যাশে মৃত্যুর প্রায় ৩৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। হেলমেট ব্যবহারের প্রবণতা বাড়লেও অধিকাংশই মানসম্মত নয়। অনেক হেলমেট শুধু প্লাস্টিকের পাতলা খোলস, যা কোনো সুরক্ষা দেয় না। বরং এ ধরনের হেলমেট ব্যবহারের ফলে মাথার আঘাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ফলে হেলমেট অবশ্যই মানসম্মত হতে হবে।
নিরাপদ গতি : প্রাণরক্ষার সহজতম উপায়
গতি বাড়লেই বাড়ে ঝুঁকি, এটি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম। গতিকে রোডক্র্যাশের একটি প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উচ্চগতি দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এবং আঘাতের তীব্রতা উভয়ই বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে এখনো অধিকাংশ সড়কে গতিসীমা স্পষ্ট নয়। যদিও সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৪(১) এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা, ২০২২-এর বিধি ১২৫(৪) অনুযায়ী গতি নিয়ন্ত্রণের বিধান রয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে বিআরটিএ ২০২৪ সালে ‘মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা ২০২৪’ জারি করে। কিন্তু নির্দেশিকার কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে না। সড়কে প্রযুক্তিনির্ভর গতি নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি, অবকাঠামোগত ত্রুটি, চালক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সিং ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং শহর ও মহাসড়কে বেপরোয়া গতি ও আইনের দুর্বল প্রয়োগ সড়ক নিরাপত্তাকে আরও বিপন্ন করে তুলছে।
সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন সময়ের দাবি
সড়ক নিরাপত্তা কোনো একক সংস্থার দায়িত্ব নয়; এটি পুলিশ, বিআরটিএ, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতসহ বহু সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে সম্ভব। কিন্তু দেশে এই ব্যবস্থাপনা এখনো খণ্ডিত। বিদ্যমান আইনগুলোতে সমন্বয় ও প্রয়োগের ঘাটতি থাকায় পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে তৈরি হচ্ছে ফাঁকফোকর। এখনই সময় একটি সমন্বিত ও আধুনিক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের, যা গ্লোবাল প্ল্যান ফর দ্য সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি (২০২১-২০৩০)-এর ‘সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এই পদ্ধতিতে গুরুত্ব দেওয়া হয় নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ গতি, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী ও নিরাপদ যানবাহনের ওপর। এর পাশাপাশি দরকার বহুমুখী পরিবহন পরিকল্পনা, মানসম্মত অবকাঠামো, শৃঙ্খলাবদ্ধ ট্রাফিকব্যবস্থা এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী দ্রুত দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। এমন একটি সমন্বিত আইন কেবল দুর্ঘটনা ও মৃত্যুহার কমাবে না বরং অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা বাড়াবে, স্বাস্থ্যব্যয় কমাবে এবং নাগরিক আস্থা ফিরিয়ে আনবে।