আপনারা যারা কথায় কথায় মীর জাফর, খোন্দকার মোশতাক অথবা আবু জেহেলকে গালাগাল করেন তারা যদি উল্লিখিত ব্যক্তিদের ইতিহাস জানেন তবে এ কথা ভেবে খুবই অবাক হবেন যে মীর জাফর, মোশতাক কিংবা আবু জেহেল তাদের জমানায় সবচেয়ে চৌকশ ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। প্রথমেই আবু জেহেলের কথা বলে নিই। তার প্রকৃত নাম ছিল আবুল হাকাম অর্থাৎ জ্ঞানীদের পিতা। তার জমানার হেজাজ-নজদ-নুফুদ-হাইল থেকে ইয়েমেনের হাদরামউত অথবা সিরিয়ার দামেস্ক পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আবু জেহেলের পরিচিতি ছিল একজন অভিজাত ধনাঢ্য, জ্ঞানী, রুচিশীল, বীর গোত্রপতিরূপে। তিনি আবু হাকাম থেকে কীভাবে আবু জেহেল অর্থাৎ মূর্খদের পিতা হলেন- তা যদি আপনি এক কথায় বলতে চান তবে আপনাকে বলতে হবে যে ৬১০ থেকে ৬২২ সাল পর্যন্ত যে আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল সেই বসন্তের রাজনীতি তিনি অস্বীকার করেছিলেন। নিজের গোয়ার্তুমি, অহংকার এবং অন্যান্য গোত্রপতি বন্ধুদের কবলে পড়ে তিনি প্রকৃত সত্য জানা সত্ত্বেও স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে মহাকালের ভিলেনে পরিণত হয়েছিলেন।
আবু জেহেলের মতো অত বিখ্যাত না হলেও ১৭৪০ থেকে ১৭৬৪ সালের সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মীর জাফর আলী খান ছিলেন অন্যতম পুরোধাব্যক্তিত্ব এবং বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজনীতির প্রাণপুরুষ। অতিশয় সজ্জন, সামরিক বিদ্যায় পারদর্শী, অত্যন্ত সুদর্শন, অভিজাত এবং যুদ্ধের ময়দানের পরীক্ষিত বীর সেনাপতি মীর জাফর কীভাবে সর্বকালের নিকৃষ্ট বিশ্বাসঘাতকের উপাধি পেলেন তা যদি নির্মোহ ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ দ্বারা বিচার-বিশ্লেষণ করেন তবে আপনি অবাক না হয়ে পারবেন না। নবাব আলীবর্দী-পরবর্তী বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার প্রাসাদ রাজনীতির কবলে পড়ে তিনি তার অন্তর্নিহিত ভালো গুণাবলিগুলো হারিয়ে ফেলেন এবং দেশিবিদেশি প্রতারক চক্র, নিজের কুপুত্র মীরনের প্রভাব এবং সঙ্গীসাথিদের লোভলালসার ফাঁদে পা দিয়ে রাজনীতির সব হিসাব এলোমেলো করে ফেলেন এবং শেষ পর্যায়ে রীতিমতো পুতুলে পরিণত হন।
খোন্দকার মোশতাকের কুখ্যাতি ১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যাকাণ্ডের দোসর এবং ’৭৫-পরবর্তী সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে, তাকে বাংলাদেশের মানুষ আবু জেহেল এবং মীর জাফরের মতোই বেইমান মোনাফেক বিশ্বাসঘাতক রূপে অবিরত অভিসম্পাত করে থাকে। অথচ ১৯৫০ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান এবং পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে খোন্দকার মোশতাকের মতো শিক্ষিত-মার্জিত, চৌকশ এবং অভিজাত রাজনীতিবিদ খুবই কম ছিল। নিজের ভিতরকার অন্তর্নিহিত লোভ, ঝুঁকি নেওয়ার পরিবর্তে কৌশল অবলম্বন এবং বঙ্গবন্ধুবিরোধীদের সঙ্গে প্রথমে আঁতাত এবং পরবর্তী সময়ে হত্যাকারীদের দোসর হয়ে তিনি ক্ষমতার মসনদে বসলেন বটে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন পুতুলনাচের মঞ্চের একজন পুতুলরূপী অভিনেতা। ইতিহাসের তিনজন ঘৃণিত ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত কাহিনি বলার পর চলুন আমরা আজকের শিরোনাম এবং দেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করি। আপনারা অনেকেই হয়তো প্রখ্যাত সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ নামক অমর সাহিত্যকর্মটি পড়েছেন। আর যারা পড়েননি তারা সবাই নিশ্চয়ই আবহমান বাংলার পুতুলনাচের দৃশ্য হাটবাজারের মজমা, রঙ্গমঞ্চ অথবা টেলিভিশন, সিনেমায় দেখেছেন। পুতুলের হাতে-পায়ে দড়ি বা সুতা বেঁধে কেউ একজন পুতুলকে নাচায় এবং পেছন থেকে মজার মজার সংলাপ বলতে থাকে, যা শুনে দর্শক ভারি আনন্দ পান। আমরা সবাই এ ঘটনা জানি, কিন্তু নির্মল আনন্দ উপভোগের জন্য পুতুলনাচের দর্শক হই। কারণ রঙ্গমঞ্চ বা হাটবাজারের পুতুলনাচ মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু রাজনীতিতে যদি পুতুলনাচের মতো ঘটনা ঘটে তবে একটি দেশের যে মহাসর্বনাশ ঘটে তা অন্য কোনোভাবে ঘটে না। রাজনীতি মানুষের সামাজিক ব্যবহারের সর্বোচ্চ স্তর। রাজনীতির চিন্তা ও দর্শন সব চিন্তা-চেতনা ও দর্শনের মধ্যে সবচেয়ে উঁচুমার্গের। এজন্য যেসব দার্শনিক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেন তাদের সঙ্গে অন্যান্য দার্শনিকের তুলনাই চলে না। আবার রাজনীতির দার্শনিকরা যখন সেনাপতি-রাজা-বাদশাহ-আমির ওমরাহ হন তখন পৃথিবীতে একের পর এক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি হয়। রোমে মার্কাস ওরলিয়াস, আরবে হজরত আলী (রা.), চীনে কনফুসিয়াস, ভারতে চাণক্য যে ইতিহাস রচনা করেছেন তা অতিক্রম করার নজির পৃথিবীতে নেই। সুতরাং রাজনীতিতে সব সময়ই শ্রেষ্ঠতর মানুষই সফল হতে পারেন। দুর্বলচিত্ত, লোভী, নীচু বংশজাত অশিক্ষিত, কুশিক্ষিত মূর্খরা যখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক বনে যান তখন একদিকে রাজনীতির সৌন্দর্যহানি ঘটে, অন্যদিকে অযোগ্য রাজনীতিবিদদের নাকে-হাতে-পায়ে-মুখে সুতো বেঁধে দেশিবিদেশি স্বার্থান্বেষী চক্র তাদের পুতুলের মতো নাচাতে থাকে।
আমাদের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ তথা আজকের বাংলাদেশ তার হাজার বছরের ইতিহাসে বহুবার পুতুল নাচার কবলে পড়েছে। পাকিস্তান জমনায় আইউব খানের খেলনার পুতুলরূপে যেমন আমরা, মোনায়েম খানকে পেয়েছিলাম তদ্রুপ স্বাধীন বাংলাদেশে মুশতাকরূপী একজন পুতুলশাসকের কারণে আমাদের গণভবন-বঙ্গভবন-ক্যান্টনমেন্ট, বিচারালয়, সচিবালয়, প্রার্থনালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজনীতির মনমননে যে নির্মমতা, রক্তের হোলিখেলার নেশা এবং মবোক্রেসির সন্ত্রাসের বীজ বর্পিত হয়েছে তা আজ বংশ বিস্তার করে সারা বাংলার ১৮ কোটি মানুষকে তাড়া করছে।
আজ আমরা স্বাধীনতার মধ্যে পরাধীনতার আতঙ্ক অনুভব করি। সংবিধান যে সব আইনের ভিত্তি এবং মানুষের হাজার বছরের আশা- আকাঙ্খা, চিন্তাচেতনা এবং মুক্তির সংগ্রামের ধারাবাহিক-স্বরলিপিরূপে যেভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখে তা আজ আমাদের কাছে তেমন গুরুত্ব বহন করে না। আমরা সংবিধান ছুড়ে ফেলার সাহস দেখাতে পারি, ক্যান্টনমেন্ট দখল, সচিবালয় তছনছ সুপ্রিম কোর্টে তাণ্ডব যখন আমাদের কাছে ডালভাত ঠিক সেই সময়ে ৮০ বছর বয়সি কোনো মহিলার টুস করে ঢুকে পড়ার কথা শুনে যেভাবে কচুপাতার পানির মতো টলটল করে কাঁপতে থাকি- তখন রাজনীতির পুতুলনাচ আমাদের কী পরিমাণ সর্বনাশ করেছে তা বোধ হয় আমরা বুঝতে না পারলেও দুনিয়ার বোবা জন্তু-জানোয়ার, বৃক্ষলতা, আকাশের চাঁদ তারারাও বুঝতে পারে আমাদের বীরত্বের ধরন ও প্রকৃতি।
২০২৫ সালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঐতিহ্যগত শ্রেষ্ঠত্ব নাকি সর্বনাশা পুতুলনাচের মহড়া চলছে তা নিয়ে আলোচনার কোনো রুচি নেই। তবে যখন পুলিশের কর্তারা মজলুম হয়ে চাকরি ছাড়ার কথা প্রকাশ্যে বলেন, যখন রাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের অধিকর্তারা নিরাপদে ভেসে যাওয়া নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বাহাস করেন তখন আমার মতো সাধারণ মানুষের মনোজগতে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। যখন উত্তর পাড়া-দক্ষিণ পাড়ার খবরাখবর ক্ষুধার যন্ত্রণার চেয়ে গুরুত্ব পায় কিংবা রাজনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পুতুলরূপী ভাড়দের পদপদবি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির ওপেন টেন্ডার হয় অথবা যখন কারও ব্যক্তিগত সহায়সম্পত্তি, সুনামসুখ্যাতি, জীবনযৌবন গ্রাস করার জন্য রাক্ষসের ন্যায় মবোক্রেসির সন্ত্রাস হাঁ করে তখন সর্বনাশা পুতুলনাচের রাজনীতির পরিণতির ভয়ংকরী রূপ আমাদের বেঁচে থাকার পরিবর্তে কবরের বাসিন্দা হওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে থাকে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক