সত্তর দশকের গোড়ার দিকে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশি সিনেমা ‘দস্যু বনহুর’। এ সিনেমাটিতে প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আজাদ রহমানের কণ্ঠে একটি গান আছে- ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়/ বাতাসের বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়/ মুখঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায়/ মানুষকে কী দেখে চিনবে বলো..’। বাস্তবিক এ দুনিয়ায় মানুষকে চেনা বড্ড কঠিন। যদিও মানুষকে চিনতে হলে নিজেকে চেনার উপদেশ দিয়েছেন গ্রিক দার্শনিক মহামতি সক্রেটিস। তিনি বলেছেন, ‘নো দাই সেলফ’ অর্থাৎ ‘নিজেকে জানো’। কিন্তু মানুষ অন্যকে জানার জন্য উৎসুক হলেও নিজেকে জানার গরজ খুব একটা অনুভব করে না। সক্রেটিসের উপদেশের কাছাকাছি বলেছেন সাধক-বাউল লালন শাহ। তিনি বলেছেন, ‘ও যার আপন খবর আপনার হয় না/ আপনারে চিনতে পারলে রে, যাবে অচেনারে চেনা।’ অচেনারে চেনার জন্য আমরা যতটা উদগ্রীব, নিজের খবর তার এক শতাংশও রাখি না। এমনকি সমাজে মানুষ আমার সম্পর্কে, আমার কাজকর্ম সম্পর্কে কী ভাবল, তাও ভেবে দেখি না। আমরা অপরের সমালোচনায় মুখর হতে যতটা উৎসাহী নিজের আমলনামার দিকে তাকাতে ততটাই অনাগ্রহী।
যাই হোক, কথা শুরু করেছিলাম মুখ ও মুখোশ নিয়ে। না, বাংলা ভাষার প্রথম সবাক সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমাদের বিক্রমপুরের গর্ব পরিচালক আবদুল জব্বার খান তাঁর ওই ছবিতে কী মেসেজ দিতে চেয়েছিলেন, তা-ও জানা হয়নি। তবে এটা বুঝেছি, তিনি হয়তো মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষের প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে রাখার কথাই বলতে চেয়েছিলেন। মুখোশ অনেক প্রকারের হয়। কাপড়ের, কাগজের, রাবারেরও হতে পারে। মানুষ তার আসল চেহারা ঢেকে রাখার জন্য কখনো কখনো মুখোশ ব্যবহার করে। আবার জীবন রক্ষার জন্যও আমরা মুখোশ ব্যবহার করি। তখন সেটাকে আমরা বলি ‘মাস্ক’। ভয়ংকর মহামারি কভিডের সময় মাস্ক ব্যবহার করেননি এমন কেউ আছেন বলে মনে হয় না। আবার জীবন হরণের নিমিত্তেও মুখোশ অনেক সময় ব্যবহার হয়। দুর্বৃত্তরা অপকর্ম সাধনের সময় নিজেদের চেহারা-পরিচয় লুকিয়ে রাখার জন্য মুখোশ ব্যবহার করে থাকে।
প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে রাখার জন্য আরেক ধরনের মুখোশ রয়েছে। সেটা বায়বীয়। চোখে দেখা যায় না, বোঝাও যায় না। কিছু মানুষ সমাজে ভালো সেজে এমন নিখুঁত অভিনয় করে যে জাত অভিনেতারাও তাদের কাছে হার মানতে বাধ্য। এরা মুখের বুলিতে সবাইকে ভুলিয়ে নিজের ঝুলি পূর্ণ করে জনচক্ষুর আড়ালে। এ মুখোশধারীরা আমাদের চারপাশেই বিরাজ করে। তাদের মুখের ‘চিনিমাখা হাসি’ আর মধুমাখা বুলিতে মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মীয় জগৎ সবখানেই এ মুখোশধারীদের সমাগম দেখা যায়। এরা কথার জাদুতে সম্মোহিত করে মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে আপন স্বার্থ হাসিল করে নেয়।
প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর ‘হুজুর কেবলা’ গল্পে ধর্মের মুখোশধারী ভণ্ডদের চরিত্র এঁকেছেন সার্থকভাবেই। গল্পটি অনেকেই পড়ে থাকবেন। এমদাদ নামে এক যুবক, বিএ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসে তার সব বিলাতি পোশাক পরিত্যাগ করে চোগা-চাপকান পরে এক সুফি সাহেবের মাধ্যমে এক হুজুরের হাতে বয়াত গ্রহণ করে মুরিদ হলো। তারপর থেকে সে তার ভক্তি-শ্রদ্ধার দ্বারা হুজুরের খাস মুরিদে পরিণত হলো। হুজুরের সঙ্গে ঘুরে ঘুরেই তার দিন কাটে। একবার হুজুর এক গ্রামে তার মুরিদের বাড়িতে তাশরিফ আনলেন। মুরিদের সদ্য বিবাহিত সুন্দরী পুত্রবধূকে দেখে হুজুরের ভিতরে লালসা জেগে উঠল। সে মুরিদকে নির্দেশ দিল পুত্রবধূর তালাকের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু যুবক নারাজ। হুজুরের অন্যান্য শিষ্য-মুরিদ বাহিনীর চাপে বুকে বেদনা চোখে জল নিয়ে বউকে সে তালাক দিল। বিয়ের দিন যুবক বারবার মূর্ছা যেতে থাকল। আর অন্দরমহলে নতুন বউটি হাপুস নয়নে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগল। এ ঘটনা এমদাদের মনকে বিদ্রোহী করে তুলল। সে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে গিয়ে বিয়ের সাজে সজ্জিত হুজুরের মেহেদিরঞ্জিত দাড়ি ও চুল টেনে বলতে লাগল- ‘রে ভণ্ড শয়তান! নিজের পাপা-বাসনা পূর্ণ করিবার জন্য দুইটা তরুণ প্রাণ এমন দুঃখময় করিয়া দিতে তোর বুকে বাজিল না?’ এ দৃশ্য দেখে হুজুরের মুরিদরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল এমদাদের ওপর। তাকে চড়-থাপ্পড় মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল। এমদাদ সবাইকে বলতে লাগল, এই ভণ্ড তোমাদের ধোঁকা দিচ্ছে। গ্রামের মাতব্বর হুকুম দিল এমদাদকে কান ধরে গ্রাম থেকে বের করে দিতে। আর হুজুর কেবলা তখন বলল, ‘দেখিস বাবারা, ওকে বেশি মারপিট করিস না। ও পাগল। ওর বাপ ওকে আমার হাতে সঁপিয়া দিয়াছিল। অনেক তাবিজ দিলাম। কিন্তু কোনো কাজ হইল না। খোদা যাকে সাফা না দেন, তাকে কে ভাল করিতে পারে?’
আবুল মনসুর আহমদ তাঁর হুজুর কেবলা গল্পে যে ভণ্ড পীরের চরিত্র অঙ্কন করেছেন, তেমন ভণ্ড পীরের দেখা মাঝেমধ্যেই পাওয়া যায়। তারা সরলপ্রাণ মানুষকে ধর্মের অপব্যাখ্যা শুনিয়ে মুরিদ বানিয়ে নিজেদের ফায়দা হাসিল করে। তেমনি এক ভণ্ড পীরের সাক্ষাৎ আমার ঘটেছিল ১৯৮৬ সালে। আমি তখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। প্রতিষ্ঠানটির মালিক একদিন সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে গেলেন এক হুজুরের দরবারে। সেখানে হুজুর তার মুরিদদের ক্লাস (!) নেন!। জানলাম ‘হুজুর’ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর। নাম মতিউর রহমান, একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টরে সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক তার ক্লাসে পাঠ নিলাম। তবে তাকে আমার মনে ধরল না। এভাবে পাঁচ দিন আমার বস তার পীর সাহেবের কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন। মুরিদ হতে বলেন, আমি হই না। অবশেষে আমি তাকে বললাম, ‘ভাই, আমার বাবা-মা এখনো জীবিত। তারাই আমার পীর। আমি অন্য কোনো পীরের মুরিদ হব না।’ আর আমার সহকর্মীদের মধ্যে যারা চাকরি বাঁচাতে মুরিদ হয়েছিল তাদের বললাম, ‘তোদের এই পীর ভণ্ড। আজ হোক কাল হোক ওর থলের বিড়াল বের হবে। কারণ ওর কথাবার্তায় আমি অর্থ ও নারীলিপ্সার ইঙ্গিত পেয়েছি। আমি আরও বলেছিলাম, একদিন দেখবি পত্রিকায় খবর বেরোবে ‘ভণ্ড পীর মতিউর গ্রেপ্তার’। এরপর আমি ওই প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে বিমা কোম্পানিতে যোগ দিই। বছরখানেক পরে ১৯৮৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে একদিন মুক্তিযুদ্ধের ১১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার (অব.) এম হামিদুল্লাহ খানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘খান ভাই মেজর মতিউরকে চেনেন, আপনার অধীনে সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিল?’ তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘ও কি এখন জেলে না বাইরে?’ আমি বললাম, ‘সে তো এখন পীর! অগণিত মুরিদ তার।’ বিস্মিত হামিদুল্লাহ খান এরপর মেজর মতিউরের কাহিনি বললেন। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় একটি হাউজিং সোসাইটি করে প্লট দেওয়ার নামে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করায় তার চাকরি চলে যায়। এরপর যায় জেলে। ১৯৮৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর পত্রিকায় দেখি কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় পীর মতিউর বাহিনীর সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের খবর। প্রায় ৫০০ পুলিশের একটি বাহিনী টানা তিন দিন মতিউর বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। অবশেষে শেষ দিন ভোরে আহত অবস্থায় পালিয়ে যাওয়ার সময় সে গ্রেপ্তার হয়। পীর বলতে আমরা যা বুঝি, মেজর মতিউর তা ছিল না। পীর মুখোশের আড়ালে সে ছিল একজন ভণ্ড, প্রতারক। অর্থ ও নারীলোভী কথিত এ পীর কথার ছলে ভুলিয়ে মুরিদদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল কোটি কোটি টাকা। পাশাপাশি সে মুরিদদের একাধিক বিয়ে করিয়ে নিজের লালসা চরিতার্থ করত। তেমনি এক মুরিদের ভাগনিকে চিকিৎসার নামে শ্লীলতাহানি করতে চাইলে মেয়েটির স্বামীর হাতে উত্তমমধ্যমও খেয়েছিল। পত্রিকায় তার কাহিনি সবিস্তারে বেরিয়েছিল সে সময়। কথিত পীর মতিউর দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে থেকে দেশে ফিরে ‘মুসলিম মিল্লাত বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন ও সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছিল। আফগানিস্তান ও ফিলিস্তিন যুদ্ধফেরত যুবকদের সমন্বয়ে গঠিত সেই বাহিনীর নেতৃত্ব দিত সে নিজেই। সে তার পাকুন্দিয়া উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামের বাড়িটিকে দুর্গের মতো করে বানিয়েছিল। ধর্মীয় পীরের ছদ্মবেশে কেন সে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছিল সেই রহস্য আজও অজানা। তবে যারা ভণ্ড পীর মেজর মতিউরের কীর্তিকলাপের প্রত্যক্ষ সাক্ষী এবং যারা তখনকার ঘটনাবলি পত্রিকায় পড়েছেন, আজও তাদের তা মনে থাকার কথা।
শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের ভণ্ড ধর্মগুরুর দেখা মেলে মাঝেমধ্যে। ভারতে জন্ম নেওয়া কথিত ধর্মগুরু ‘ভগবান রজনীশ’র কাহিনি আমরা জানি, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে তার আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন। অরেকজন গুরমিত রাম রহিম সিং। ধর্মগুরু পরিচয়ের মুখোশের আড়ালে সে ছিল নারী সম্ভোগ আর নৃশংসতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। যুগে যুগে এসব ভণ্ড-প্রতারক ধর্মকে অপব্যবহার করে নিজেরা ফায়দা লুটেছে, সাধারণ মানুষকে করেছে বিভ্রান্ত। তবে পরিণামে তাদের মুখোশ খসে পড়েছে। বেরিয়ে এসেছে কদাকার চেহারা।
আসলে নানা রকম মুখোশ পরে ভণ্ডরা সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে কল্কে পেয়ে থাকে। কেউ রাজনীতিবিদ-জনপ্রতিনিধি, কেউ সমাজসেবক, কেউ ধর্মগুরু, কেউ দরবেশ। দেশ ও মানবসেবার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মাধ্যম রাজনীতি। আমাদের পূর্বসূরির অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তি নিজেদের ধনসম্পদ উজাড় করে দিয়েছেন মানবসেবার এ মাধ্যমে আত্মনিয়োগ করে। তারা রাজনীতিতে আসতেন দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে, কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নয়। কিন্তু আজ আমরা দেখি মানুষের বিচরণের সব ক্ষেত্রের মধ্যে রাজনীতিতে ভণ্ড-প্রতারকদের সমাবেশটাই বড়। এই ভণ্ড-প্রতারকদের উৎপাতে রাজনীতি আজ কলুষিত, সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত-লম্পট-লুম্পেন রাজত্ব করছে রাজনীতির রাজ্যে। পুরোনোরা তো আছেই, নতুনরাও গা ভাসিয়েছে ভণ্ডামি আর দুর্বৃত্তায়নের স্রোতে। রাজনৈতিক কর্মী (ওরা অবশ্য নিজেদের নেতা দাবি করে) হিসেবে যাদের বয়স এক বছরও হয়নি, তাদের অনেকের যখন শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার খবর চাউর হয়, তখন জনসাধারণকে আবু জাফর শামসুদ্দিনের ‘কলিমুদ্দিন দফাদার’ গল্পের সংলাপ আওড়াতে ইচ্ছা করে- ‘অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়।’ পুরোনো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের অপকর্মে অতিষ্ঠ জনগণ যখন নতুনদের দিকে চেয়ে আবার বুক বাঁধতে চেয়েছিল, তখনই মুখোশের আড়াল থেকে তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে এলো। দেখা গেল নতুন কিছুই নয়, এ যে পুরোনোর নতুন সংস্করণ! একেবারে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ প্রবচনের সার্থক উদাহরণ। চারদিকে আজ মুখোশধারী ভণ্ড-প্রতারকদের জয়জয়কার। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাই আক্ষেপ করে লিখে গেছেন- ‘হায় রে ভজনালয়, তোরই মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।’
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক