সুস্থতা ও সুস্বাস্থ্য আল্লাহর এক মহা নেয়ামত। এটা যে কত বড় নেয়ামত, অসুস্থ হলেই কেবল আমরা উপলব্ধি করতে পারি। অথচ সুস্থ অবস্থায় আমরা সুস্থতার নেয়ামতের বিষয়ে উদাসীন থাকি। রসুল (সা.) বলেছেন, দুটি নেয়ামত এমন আছে- যার ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ উদাসীন। সুস্থতা ও অবসর (বোখারি)।
শারীরিক সুস্থতা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা ইসলামের নির্দেশনা। সুস্বাস্থ্য শুধু জাগতিক বিষয়ই নয়, এর সঙ্গে ইসলামের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অল্প ইবাদতকারীর চেয়ে অধিক ইবাদতকারী যেমন আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়, তেমনই দৈহিকভাবে দুর্বল ইমানদারের চেয়ে দৈহিকভাবে শক্তিশালী ইমানদার আল্লাহর কাছে প্রিয়। এ মর্মে রসুল (সা.) বলেছেন, শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিনের তুলনায় আল্লাহর কাছে উত্তম ও অধিক প্রিয় (মুসলিম)। অর্থাৎ কেউ যদি অসতর্কতাবশত নিজের স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির ভিতর ফেলে তবে তার থেকে আল্লাহর কাছে ওই মুমিন প্রিয়, যে সতর্কতা অবলম্বন করে সুস্থ থাকে।
আমাদের জীবন, শরীর এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আল্লাহর তরফ থেকে আমাদের কাছে আমানত। আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন ও স্বাস্থ্য ক্ষতির দিকে ঠেলে দিতে পারি না। এটা গুনাহের কাজ। মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা তোমাদের হাত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না (বাকারা)। হাদিসে এসেছে, রসুল (সা.) বলেছেন, তোমার ওপর তোমার শরীরের হক রয়েছে। অতএব প্রত্যেক হকদারকে তার হক দাও (বোখারি ও মুসলিম)।
এ হাদিস দ্বারা বোঝা গেল, অন্যান্য নানা হকের মতো শরীরেরও হক রয়েছে। আমরা যখন শরীরকে সুস্থ রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেব ও কার্যকর পথ অবলম্বন করব, তখনই আমার শরীরের হক আদায় করা হবে। আর আমরা যদি শরীরের ওপর জুলুম করি, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে শরীর অসুস্থ করে ফেলি তবে আমরা শরীরের হক নষ্ট করলাম। এ কারণেই ইসলাম আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ করেছে এবং ভয়ংকর পাপ বলেছে। কেননা, আমার ওপর আমার প্রাণের হক রয়েছে। সেই প্রাণ আমি স্বেচ্ছায় নষ্ট করতে পারি না। সুস্থ থাকতে সবার আগে প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ খাদ্য-পানীয়। এর সঙ্গে দরকার নিরাপদ ওষুধ। প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার নাগরিকদের জন্য নিরাপদ খাদ্য-পানীয় ও ওষুধের ব্যবস্থা করা। এটা নাগরিকের মৌলিক অধিকার। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো- এখন পর্যন্ত সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য-পানীয় ও ওষুধ নিশ্চিত করা যায়নি। এর দায় আমরা এড়াতে পারি না। বরং দিন যত যাচ্ছে দূষিত পানি, খাবারের ভেজাল ও বিষক্রিয়া ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাইরের কোনো খাবার খেতে গেলে আমাদের খটকা লাগে। না জানি এটা খেয়ে অসুস্থ হয়ে যাই! আবার যে ওষুধ খেয়ে আমরা সুস্থ হব, কখনো কখনো সেই ওষুধের ভিতরও ভেজাল থাকে। এদেশে নিরাপদ খাদ্য-পানীয়-ওষুধের যে সংকট চলছে, তা আজকের এই উন্নত পৃথিবীতে অত্যন্ত বিরল।
খাদ্য ও ওষুধ ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জোরালো পদক্ষেপ নেই। রাষ্ট্র যত দিন না এ বিষয়ে কঠোর হচ্ছে তত দিন এ দুর্ভোগ আমাদের সহ্য করে যেতে হবে। যারা ভেজাল খাদ্যপণ্য বিক্রি করে, খাবারে ফরমালিন ও কেমিক্যাল মেশায়, তাদের আল্লাহর ভয় তো নেই-ই, মানুষের স্বাস্থ্যের কথাও তারা একবার চিন্তা করে না। ভেজাল খাবার খেয়ে এ দেশের বহু মানুষ প্রতিদিনই একটু একটু মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাউকে সরাসরি হত্যা করা যেমন হত্যা, তেমনই বিষযুক্ত খাবার বিক্রি করে জনগণকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়াও এক ধরনের হত্যা। অথচ এ বিষয়টা নিয়ে ভেজালকারীদের ন্যূনতম ভয় ও অনুশোচনা নেই। একটা সময় কিডনি রোগীর সংখ্যা খুবই কম ছিল। এখন কিডনি রোগীর সংখ্যা এত ভয়াবহ আকারে বাড়ছে, আশপাশে খোঁজ নিলেই দুই-একজন কিডনি রোগী পেয়ে যাবেন। ডায়ালাইসিস করার জন্যও হাসপাতালগুলোতেও লম্বা সিরিয়াল দিতে হয়। কিডনি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? এর প্রধান কারণ ভেজাল ও বিষযুক্ত খাবার। আমাদের প্রতিদিনের গ্রহণ করা খাবার এতটাই বিষাক্ত যে কিডনি তার ছাঁকনি দিয়ে ঠিকমতো ছাঁকতে পারছে না। যার ফলাফল কিডনি ড্যামেজ। কিডনির পাশাপাশি ক্যানসার এবং হার্টের রোগী এখন ঘরে ঘরে। একটা জাতির জন্য এটা যে কত বড় সর্বনাশা বিষয়, তা সহজেই অনুমেয়। তবে শত সমস্যার মাঝেও সুস্থ থাকার জন্য আমাদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের সব সময় স্বাস্থ্যকর খাবারের ওপর জোর দিতে হবে। এটা শুধু পার্থিব বিষয় জড়িত নয়, এটা আমাদের ইবাদতের অংশ।
নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও নিরাপদ খাদ্য-পানীয়-ওষুধ নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পাশাপাশি যারা খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার সঙ্গে জড়িত, তাদেরও উচিত এ ঘৃণ্য অপরাধ থেকে বের হয়ে আসা। এখনো যদি আমরা সজাগ না হই, তবে এ দেশের জনশক্তি ও স্বাস্থ্য-সম্পদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
জুমার মিম্বর থেকে বয়ান গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ