ঢাকা মহানগরীর উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) ডিলার নিয়োগে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। পছন্দের প্রার্থীকে ডিলারশিপ দিতে অনেক আবেদন বাদ দেওয়া হয়েছে। আবেদন ঘষামাজা করে কাঙ্ক্ষিত কেন্দ্রের পরিবর্তে অন্য কেন্দ্রে আবেদন গ্রহণ করা এবং আত্মীয়-স্বজনের নামে একই ব্যক্তির একাধিক আবেদন আমলে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে এমন জাল-জালিয়াতির নেপথ্যের কারিগর সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট।
ভুক্তভোগীদের দাবি, কারসাজির মাধ্যমে অন্তত ৪৩ জনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ডিলারশিপ দেওয়া হয়েছে। জনপ্রতি পাঁচ থেকে সাত লাখ করে টাকা নেওয়া হয়েছে। এদের অনেকেই ফ্যাসিবাদী মামলার আসামি এবং ওএমএসের চাল আত্মসাতের অভিযোগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও ডিলার নিয়োগ কমিটির প্রধান ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
রবিবার ঢাকা রেশনিং দপ্তরের সামনে মানববন্ধন ও খাদ্য ভবনেও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন ভুক্তভোগীরা। তাঁরা স্বচ্ছতার সঙ্গে পুনরায় লটারির দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে অভিযোগ তদন্তে ঢাকার একজন বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে সদস্য রাখা হয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, ঢাকা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও ঢাকা রেশনিংয়ের একজন করে প্রতিনিধি। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করেছেন ডিলার নিয়োগ কমিটির প্রধান ও ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। রবিবার তিনি বলেন, ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। আমরা জরুরি বৈঠক করে একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। তাঁদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করা হবে। দোষী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
জানা গেছে, গত ১৫ বছর ধরে ঢাকাসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাই ওএমএসের ডিলারশিপ পেয়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অনেকে পালিয়ে গেলেও আইনি জটিলতার কারণে ওই সময় তাঁদের অপসারণ করা যায়নি। রাজধানীসহ সারা দেশে নতুন করে ওএমএসের ডিলার নির্বাচিত করার উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রতিটি বিভাগে বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। সাচিবিক সহায়তা দেন বিভাগের রেশনিং প্রধান।
এর ধারাবাহিকতায় গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন (আইইবি) ভবনে রাজধানীর ডিলার নিয়োগের লটারি অনুষ্ঠিত হয়। তবে নিয়ম অনুযায়ী আগে থেকে লিখিত নোটিশ না দিয়ে কেবল নির্বাচিত কিছু ডিলারকে মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে ডাকা হয়। ওই এসএমএসকেই প্রবেশের গেটপাস হিসেবে গণ্য করা হয়। এ কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী এসএমএস না পেয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে প্রতিবাদ করেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, কেন সব আবেদনকারী লটারির বার্তা পাননি? নোটিশ ইস্যু না করে শুধু মোবাইল বার্তায় কেন ডাকা হলো? কেন সংবাদপত্র, বিজ্ঞপ্তি বা নোটিশ বোর্ডে কোনোরূপ প্রচার করা হলো না? এ সময় উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীরাও প্রতিবাদ করলে চূড়ান্ত নথিতে অনুমোদন দেননি নিয়োগ কমিটির প্রধান বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। তিনি বিষয়টি তাৎক্ষণিক জানান খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক (সিসিডিআর) জাহাঙ্গীর আলম সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের আস্থাভাজন কর্মকর্তা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এই দপ্তরে কর্মরত আছেন। ২০২২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তাঁকে বরিশালের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি ফুড) পদে বদলি করা হয়। বদলির ছয় মাসের মাথায় সাধন চন্দ্র মজুমদারের জামাতা আবু নাছের বেগকে ‘ম্যানেজ’ করে ফের একই পদে ফিরে আসেন, যা খাদ্য বিভাগের বদলি পদায়ন নীতিমালার পরিপন্থী। ঢাকা রেশনিংয়ে ফিরেই তিনি কয়েকজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। এর সদস্যরা হলেন সাধন চন্দ্র মজুমদারের অন্যতম ক্যাশিয়ার ও তোফায়েল আহমেদের আস্থাভাজন এরিয়া রেশনিং কর্মকর্তা (এআরও) তৌফিক এলাহী, ইডেন কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী লীনা আহমেদ, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজার আত্মীয় রাহাতুল ইসলাম, গোপালগঞ্জের ছাত্রলীগ নেতা মামুন হোসেন ও শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী কৃষিবিদ মশিউর রহমান হুমায়নের ভাতিজা শামীম আহমেদ প্রমুখ। জুলাই অভ্যুত্থানের পরও সাধন সিন্ডিকেটের হোতারাই মূলত ডিলার নিয়োগসংক্রান্ত কাজে যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া সিসিডিআর জাহাঙ্গীর আলম নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব।
ভুক্তভোগীদের দাবি, বিনা লটারিতেই ডিলারশিপ পান ৪৩ জন। এঁদের বিনা লটারিতে ডিলারশিপ দিতেই মূলত দুর্নীতির আশ্রয় নেয় রেশনিং কর্মকর্তারা। অনেক ডিলারকে বৈষম্যমূলকভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। এলাকাভিত্তিক সব আবেদনকারীর তালিকা প্রকাশ করতে হবে এবং স্বচ্ছভাবে নাম উত্তোলন করতে হবে।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নিয়োগ কমিটির সদস্যসচিব ও ঢাকা রেশনিং প্রধান নিয়ন্ত্রক (সিসিডিআর) জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, ‘আমি গত ১৫ বছর বঞ্চিত কর্মকর্তাদের একজন। ডিলার নিয়োগে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। রেশনিং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সঠিকভাবেই দায়িত্ব পালন করেছেন। তার পরও নিয়োগ কমিটিসহ বিভিন্ন জায়গায় লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এ কারণে এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করতে একজন বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’ সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ