জীবন থেকে প্রতিদিন আমরা কিছু না কিছু শিখছি। জীবনের ভিতরটাতে কিন্তু এত সহজে প্রবেশ করা যায় না। খুব দুর্বোধ্য। চোখে দেখা যায় না, অনুভূতি দিয়ে বুঝতে হয়। অতিমানবীয় চশমা দিয়ে দেখতে হয়। আসলে স্রষ্টা মানুষকে এক অভূতপূর্ব বৈচিত্র্যের সমন্বয়ে তৈরি করেছেন। প্রতিটা মানুষ রঙে, বৈশিষ্ট্যে, আকারে-প্রকারে, ভাবে-অনুভবে একেবারেই আলাদা। এই বৈচিত্র্যই হচ্ছে পৃথিবীর সৌন্দর্য। পৃথিবীর সব মানুষের ভাষা, ধর্ম, পোশাক, কালচার যদি হুবুহু এক হতো তাহলে কিন্তু পৃথিবীটা নিরানন্দ ও একঘেয়েমিতে ভরে যেত। পৃথিবীর সব বাগানে যদি একই ফুল ফুটত, সব শিল্পী যদি গাইত একই মেজাজ বা একই ধরনের গান, সব আঁকিয়ে যদি আঁকত একই ছবি তাহলে কিন্তু গড়ে উঠত না কালজয়ী সব শিল্পকর্ম।
আবার প্রতিটা মানুষের জীবনে রয়েছে কতগুলো অধ্যায় বা পর্ব। সময় যত এগোতে থাকে একেকটা অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে এবং নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এ সমাপ্তি আর সূচনার সঙ্গে সঙ্গে জীবনে অনেক নতুন নতুন মানুষের আগমন ঘটে। বলা বাহুল্য এসব মানুষের বেশির ভাগই টেম্পোরারি। আজ যখন পেছন ফিরে তাকিয়ে জীবনের ভুলভ্রান্তিগুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া করি বা স্মৃতির পাতাগুলো উল্টে দেখি তখন খুব অবাক লাগে। একসময় যাদের সান্নিধ্য চিরদিনের মনে হয়েছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেসব স্মৃতি ধূসর হয়ে গেছে। তবে টেম্পোরারি মানুষের ভিড়ে এমন কিছু মানুষ জীবনে চলে আসে যারা আজীবন থেকে যায়। যাদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো কখনো মলিন হয় না। তারা যেন একসময় মনের অজান্তেই পরিবারের অংশ হয়ে যায়। আসলে মানুষের জীবন খুব বিচিত্র। আর এই বিচিত্র জীবনে কত-শত বিচিত্র ঘটনাই না ঘটে। মানুষের জীবনই শুধু বৈচিত্র্যময় নয় প্রাণীদের জীবনও বৈচিত্র্যময়। মৌমাছি ফুল থেকে বিন্দু বিন্দু মধু আহরণ করে মৌচাক গড়ে তোলে। রাজা-রানী-প্রজা নিয়ে সাম্রাজ্য তৈরি করে। কিন্তু ফুল জীবন থেকে যা হারায় তা কী আর ফিরে পায়? সে হারানোর কষ্টটা ফুল যতটা বোঝে মৌমাছি কী তা বোঝে? আবার মৌমাছির বিন্দু বিন্দু ঘামে গড়া মৌচাকটা ভেঙে মানুষ মধু বের করে আনে। হাতে আগুন নেয়, একটা অসহিষ্ণু মন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘর ভাঙার আনন্দে। মৌমাছির বোবা কষ্টটা কী মানুষ কখনো বুঝতে পারে? কেউ হয়তো বলবে এটা ফুলের কষ্ট নয়, ফুলের ত্যাগ। মৌমাছিরও মৌচাক হারানোর কষ্ট নয়, মৌমাছির ত্যাগ। আসলে মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে অনেক সময় প্রকৃতিগতভাবে সম্পর্কের একটা ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, যা কেউ বুঝে উঠতে পারে না। অনেকটা অঙ্কের মতো, যা দিয়ে জীবনের সমীকরণ মেলানো যায় না।
এবার আসি পিপীলিকা সমাচারে। পিঁপড়ে একটি ক্ষুদ্র প্রাণী হলেও এদের বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে অনেকেই অনেক কিছু শুনে থাকবেন। বুদ্ধিমান মানুষের পরেই পিঁপড়েকে বুদ্ধিমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরাও মানুষের মতো সামাজিক জীব। এদের রাষ্ট্র, দল, সামাজিকতা, খেতখামার, বাজারঘাট সবই মানুষের মতো রয়েছে। এমনকি মৃত পিঁপড়ের মানুষদের মতোই দাফন হয়। এদের সমাজকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। রানীর দল, শ্রমিক দল এবং পুরুষ দল। এই ক্ষুদ্র প্রাণীর কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। পিঁপড়ে বহুবিদ গুণে গুণান্বিত। এদের দলবদ্ধতা, শৃঙ্খলাবোধ, ধৈর্য, সহনশীলতা, পরোপকারিতা, দূরদর্শিতা খুবই লক্ষণীয়, যা মানুষকেও হার মানায়। এরা এতটাই পরিশ্রমী যে নিজ দেহের ওজনের তুলনায় ২০ গুণ ভারী ওজন বহন করতে পারে। মানুষ আর পিপীলিকার মধ্যে একটি নিগূঢ় পার্থক্য হলো ওরা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে। আর মানুষেরা বড়ই স্বার্থপর। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না।
আজকাল মানুষ কেন জানি বেশি রকম আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। স্বার্থপরতা তাকে পেয়ে বসেছে। বিনা প্রয়োজনে সে কিছুই করে না। সবকিছু করার পেছনে তার স্বার্থ থাকে। এমনকি উপকার করার পেছনেও গোপন স্বার্থ লুকিয়ে থাকে। কিছু মানুষ আছে যারা তাদের প্রয়োজনে খুব কাছের মানুষ হয়ে যায়, আবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার কিছু মানুষ আছে যারা প্রচণ্ড রকম কৌশলী। ছলে বলে কৌশলে নিজের স্বার্থটুকু আদায় করে নিতে সিদ্ধহস্ত। এদের বোঝা বড়ই মুশকিল। এরা সব সময় আত্মপ্রশংসায় মগ্ন থাকে। অর্থাৎ আমি ভালো, আমি জ্ঞানী, আমি কর্মঠ, আমি সততার মূর্ত প্রতীক। এরা হচ্ছে আমিত্ববাদী মানুষ। দিনমান নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে ব্যস্ত। এরা কোনোভাবেই অন্যের প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। এদের একটাই কাজ, তাহলো অন্যের পেছনে লেগে থাকা, দোষ ধরা ও সমালোচনা করা।
প্রাণীরা কিন্তু মানুষের মতো অতটা স্বার্থপর হয় না। মানুষের মধ্যেই স্বার্থপরতা তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে সাধারণভাবে প্রাণীরা তাদের প্রজাতি বা দলের স্বার্থে কাজ করে। আবার এই প্রাণীদের মধ্যেও যে সংবেদনশীল শক্তি রয়েছে, তা কিন্তু কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। মানুষের মতো তাদের প্রকাশভঙ্গি না থাকলেও আঘাত পেলে সেই কষ্টটা তারাও অনুভব করে। এ ছাড়া মানুষের জীবন-জীবিকা এবং ভালো থাকার পেছনে প্রাণীদের রয়েছে অনেক অবদান। পরিবেশ সুরক্ষায় রাখছে বিশাল ভূমিকা। অর্থাৎ পৃথিবী রক্ষায় প্রাণিকুলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আর এজন্যই প্রাণিবান্ধব সমাজ গড়ে তোলা দরকার। সাধারণত মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব হয়। আবার কখনো কখনো মানুষের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর সখ্য তৈরি হয়। তবে প্রকৃতিতেও নানা রকম বন্ধনের কথা শোনা যায়। প্রাণিকুলের নিজেদের মধ্যেও সুসম্পর্ক হয়। এটি কেবল মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। অনেক প্রাণী একে অপরের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী এবং পারস্পরিক সুসম্পর্ক তৈরি করে, যা বন্ধুত্বের সংজ্ঞার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, যেমনটি মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এই সম্পর্কগুলো সাধারণত জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে গড়ে ওঠে। আবার কিছু ক্ষেত্রে এটি কেবল পারস্পরিক সহানুভূতি এবং সঙ্গ উপভোগ করার জন্য হয়ে থাকে। প্রাণিজগতের বহু প্রজাতি নিজেদের প্রয়োজনে গড়ে তোলে সখ্য। অর্থাৎ বন্ধুত্ব ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মধ্যেও হয়। খাবার সংগ্রহ, দীর্ঘ জীবনাচার ও নির্ভরতায় তাদের মধ্যে তৈরি হয় বন্ধুত্ব। বিভিন্ন গবেষণায় তার প্রমাণও মিলেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বন্ধুত্ব মানুষকেও হার মানায়। প্রাণিজগতে এমনি একটি বন্ধুত্বের গল্প আজ তুলে ধরছি।
একদিন এক পিঁপড়ের খুব পানির পিপাসা পেল। সে নদীর পাড়ে এলো পানি খেতে। তখন নদীতে ছিল প্রচণ্ড ঢেউ। যেই পানি খেতে গেছে ওমনি পিঁপড়ে পানিতে ভেসে গেল। ওই সময় গাছের ডালে বসা ছিল একটা ঘুঘু পাখি। সে সব দেখতে পেল। ভাবল, পিঁপড়েটাকে বাঁচাই। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সে একটা পাতা মুখে নিয়ে পিঁপড়েটার সামনে ফেলে দিল। পিঁপড়ে পাতাটা দেখতে পেল। সে সাঁতরে পাতার ওপরে উঠল। ঘুঘু পাতাটা ঠোঁটে তুলে নিয়ে ডাঙায় এনে রাখল। পিঁপড়েটা প্রাণে বেঁচে গেল। এ কৃতজ্ঞতা থেকেই ঘুঘু তার বন্ধু হয়ে গেল।
অনেক দিন পরের কথা। এক শিকারি এলো নদীর পাড়ে। তার হাতে ছিল তির-ধনুক। গাছের ডালে বসে ছিল ঘুঘুটি। শিকারি তার দিকে তির তাক করল। পিঁপড়েটি কাছেই ছিল। সে বুঝতে পারল ঘুঘুর খুব বিপদ। শিকারি তির ছুড়তে যাচ্ছিল। অমনি পিঁপড়ে দিল তার পায়ে কামড়। শিকারির হাত গেল কেঁপে। তির চলে গেল আরেক দিকে। ঘুঘু ফুরুত করে উড়ে গেল। প্রাণে বেঁচে গেল সে। জয় হলো মানবতার।
পশুর মধ্যে যদি মানবিক গুণাবলি প্রবেশ করে, তাহলেও সে পশুই থেকে যায়। কিন্তু পাশবিক চরিত্রগুলো যদি মানুষের মধ্যে ঢুকে যায়। তাহলে সে পশু বা তার চেয়ে অধম হয়ে যায়। পশু কখনোই তার নিজস্ব জ্ঞাতিগোষ্ঠীকে আক্রমণ করে না। কিন্তু পশুরূপী মানুষ নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। তাই তো বলা হয়, মানবতা ও নৈতিকতাহীন মানুষ চেহারায় মানুষ হলেও প্রকৃত মানুষ নয়। অর্থাৎ মানবতাহীন মানুষ পশুসমতুল্য।
বর্তমান সমাজে দিনদিন নৈতিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অভাব এক গভীর সংকটের সৃষ্টি করছে। প্রতিনিয়ত আমরা বিভিন্ন মাধ্যম ও অভিজ্ঞতার আলোকে এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাচ্ছি। পিতা-মাতা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের মধ্যে এই অবক্ষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে নতুন প্রজন্মের সামনে এক ভয়ানক নৈতিক সংকট দেখা দিচ্ছে, যা সবার জন্যই উদ্বেগের কারণ। যেমন পরিবার হলো একটি শিশুর প্রথম শিক্ষালয়। কিন্তু যখন একটি শিশু দেখে তার পিতা-মাতা আর্থিক অনিয়ম বা অনৈতিক কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে তখন তার মনে একধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। কারণ পিতা-মাতার কর্মকাণ্ডই তাদের মূল আদর্শ। যদি সেই আদর্শে ভেজাল থাকে, তবে সন্তানও সেই ভুল পথে পা বাড়াবে। একজন অসৎ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি অন্যের মঙ্গলের চেয়ে নিজের স্বার্থ এবং আকাঙ্খাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। দুর্নীতির মাধ্যমে হয়তো সে বিশাল সম্পদ অর্জন করতেই পারে, কিন্তু এটি প্রতারণা, কারসাজি এবং শোষণের ভিত্তির ওপর নির্মিত।
প্রাণিজগতের মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের রাষ্ট্র, নেতা, ক্ষমতা, ধর্ম, জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবকিছু আছে। এসব কিছুর যোগফল নিয়ে মানবকুল পৃথিবীটাকে শাসন করছে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করছে। কিন্ত আমরা কী সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারছি? আমাদের নৈতিকতাবোধের এতটা অধঃপতন কেন হচ্ছে? কেনই-বা মূল্যবোধের এই অবক্ষয়? আমার কিন্তু আদিম যুগের আদিম সমাজে ফিরে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, নিজেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য তাদের যে আদিমতা সেটি বর্তমান আদিমতার চেয়ে কম না বেশি ছিল। আরও জানতে ইচ্ছে করে, জীবসত্তা থেকে মানবসত্তায় আমাদের উত্তরণ কবে ঘটবে?
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক