রূপপুর প্রকল্পের বিদ্যুৎ উৎপাদনে আসার জন্য যে নির্ধারিত সময় তা এরই মধ্যে কয়েক দফা পিছিয়েছে। কিন্তু এরপরও প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না যে, কবে নাগাদ দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে। এর আগে সময়মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনে না আসার জন্য সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ শেষ না হওয়াকে দায়ী করা হয়েছিল। কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নির্মিত সঞ্চালন লাইন ২ জুন চালু করে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। এ লাইন চালুর দুই মাসের মধ্যে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, চলতি বছরের শেষে প্রকল্পের ফুয়েল লোড শুরু হতে পারে। সে হিসেবে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালে এর প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বারবার এ প্রকল্পের উৎপাদন পিছিয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। আবার এত আগে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফুয়েল আনার কারণে এর গুণগত মান বজায় থাকার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। যারা এ প্রকল্পে কাজ করছেন সময়মতো উৎপাদনে না আসায় তাদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। আবার বহির্বিশ্বে এ প্রকল্পের যারা বিনিয়োগকারী-রাশিয়া, আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নিউক্লিয়ার পাওয়ার হ্যান্ডেলিং নিয়ে বাংলাদেশ ইমেজ সংকটে পড়ছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দলের অনুপস্থিতি এবং কর্মী ছাঁটাইসহ বেশ কিছু কারণে রূপপুর প্রকল্পের সময়মতো উৎপাদনে আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ প্রকল্পে ছয় মাস ধরে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের আসা বন্ধ রয়েছে। রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজ তদারকি করতে এবং রাশিয়ার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যন্ত্রপাতি বুঝে নিতে ভারতীয় বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পাঠানো চাহিদার ভিত্তিতে ছয় মাস পরপর দেশটি থেকে বিশেষজ্ঞরা আসেন। শেষ গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ দল যাওয়ার পর রূপপুর কর্তৃপক্ষ নতুন করে বিশেষজ্ঞ চেয়ে আর চাহিদা পাঠায়নি। এরই মধ্যে চাকরিতে বৈষম্যের প্রতিবাদে বিভিন্ন দাবি জানান রূপপুরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. কবীর হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিডিউল ছিল এ বছরের শেষ নাগাদ নিউক্লিয়ার ফুয়েল লোড করা হবে। তবে ফুয়েল লোড করা হলেই যে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে এমন নয়। এই ফুয়েল লোড করতেও এক মাস সময় লাগে। ফুয়েল লোডের পর কিছু কনফিগারেশন আছে যাকে সাবক্রিটিক্যাল স্টেজ বলে। এখানে নিউট্রন দিয়ে ফিউশন রিঅ্যাকশন ঘটানো হয়। এই নিউট্রন প্রোডাকশনটা জিরো। এটা হচ্ছে সাবক্রিটিক্যাল স্টেজ, যার জন্য এক মাস লাগে। এরপর পাওয়ার স্টার্ট হয়। আর গ্রিডে সিনক্রোনাইজ হতে আরও এক মাস লাগে। ফুয়েল লোডিং শুরু করে গ্রিড সিনক্রোনাইজেশন হতে ১০০ দিন সময় লাগে। এটা আমরা থাম্বরুলে বলি। রূপপুর প্রকল্প কবে থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে এজন্য আমাদের কাছে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। গত জুন মাসের ৩ তারিখে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে জেসিসি বৈঠক হয়েছে সেখানে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, বছরের শেষ নাগাদ রূপপুর প্রকল্পে ফুয়েল লোড হবে। এক্ষেত্রে হিসাব অনুযায়ী রূপপুরের প্রথম ইউনিটের উৎপাদন ২০২৬ সালের আগে আসছে না।
এর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রূপপুর প্রকল্পের প্রথম ইউনিট থেকে উৎপাদন শুরুর কথা ছিল। পরে এটি পিছিয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া হয়। আর দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর কথা ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। এটি পিছিয়ে ২০২৫ সালে নেওয়া হয়। তবে এ ইউনিট থেকে ২০২৭ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে। জুলাই ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল। তবে গত বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ডিসেম্বর ২০২৭ সাল পর্যন্ত করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রূপপুর প্রকল্পের কংক্রিট ঢালাই থেকে শুরু করে ২০২৫ সাল পর্যন্ত আট বছর হয়ে গেছে। অথচ সাত বছরে বেলারুশ রাশিয়ার কারিগরি সহায়তা নিয়েই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু করে ফেলেছে। আবার এত আগে ফুয়েল আনার কারণে তার গুণগত মান বজায় থাকার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুই বছরের বেশি সময় ধরে যদি ফুয়েল রেখে দেওয়া হয় তাহলে এটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। একদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি অন্যদিকে বারবার এর উৎপাদনে আসার সময় পিছিয়ে যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে কন্ট্রাক্ট প্রাইস যদি নাও বৃদ্ধি পায় এখানে বেশ কিছু ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এর ফলে পার ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য বেড়ে যাবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এলে আমাদের জ্বালানি আমদানি ব্যয় কিছুটা সাশ্রয় হতো। আবার প্রকল্পের যন্ত্রপাতি অনেক দিন বসিয়ে রাখা হয়েছে এগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। এটি কবে চালু হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আর বহির্বিশ্বে এ প্রকল্পের যারা বিনিয়োগকারী অর্থাৎ রাশিয়া, আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নিউক্লিয়ার পাওয়ার হ্যান্ডেলিং নিয়ে বাংলাদেশ ইমেজ সংকটে পড়ছে।