দক্ষিণাঞ্চলের প্রত্যন্ত জনপদ পটুয়াখালীর কলাপাড়ার বুকে গড়ে ওঠা পায়রা সমুদ্রবন্দর যেমন উজ্জ্বল সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছে, তেমনি সমালোচনার মুখেও পড়েছে। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আয় হয়েছে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়নেও ধীরগতি। ২০৪৩ সালের মধ্যে লাভের টার্গেট করা হয়েছে। কেউ এটিকে দক্ষিণ বাংলার অর্থনৈতিক উত্থানের সোপান হিসেবে দেখছেন। কেউ বলছেন, এটি এক ব্যয়বহুল ভুল। যার ভার বইবে দেশের জনগণ। ২০১৩ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ এখন পর্যন্ত ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ২০২৬ সালের জুলাই থেকে পুরোদমে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে এগোচ্ছে প্রকল্প। অনেকেরই প্রশ্ন- এ বন্দরের ভবিষ্যৎ কতটা টেকসই।
সরেজমিন দেখা গেছে, আধুনিক জেটি নির্মাণ শেষ হয়েছে। রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ চলমান। আন্ধারমানিক নদীর ওপর প্রায় এক দশমিক ২ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর কাজ চলছে। বন্দর ঘিরে স্থানীয় দোকানপাট, হোটেল-মোটেল, পরিবহন এবং নির্মাণকাজে যুক্ত হয়েছেন হাজারো শ্রমিক। জনশূন্য চর এখন কর্মমুখর। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী (জেটি) মোস্তফা আশিক আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, ৯০ শতাংশ কাজ হয়েছে। ৬৫০ মিটার দীর্ঘ জেটি প্রস্তুত। সেতু ও মহাসড়কের কাজ শেষ হলে ঢাকার সঙ্গে দ্রুত ও নির্বিঘ্ন সংযোগ তৈরি হবে। তিনি বলেন, আমরা আগামী বছরের জুলাই থেকে পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করতে পারব। এখনই কয়লা ও পাথরের জাহাজ ভিড়েছে। খোলা পণ্য, গাড়িবাহী কার্গো- সব ধরনের হ্যান্ডলিংয়ে প্রস্তুতি রয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আয় হয়েছে ২ হাজার কোটির বেশি। চ্যানেলের গভীরতা সাড়ে ছয় মিটারের বেশি। ৪০ থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন মালবাহী মাদার ভেসেল ভিড়তে পারে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে গভীরতা ১০ দশমিক ৫ মিটারে উন্নীত করা গেলে এটি দেশের গভীরতম চ্যানেল হবে। ইতোমধ্যে দুটি হপার ড্রেজার কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, পলিবহনের কারণে চ্যানেলে পলি জমে। তবে নিজস্ব ড্রেজিং ব্যবস্থা হলে খরচ কমে আসবে। প্রতি কিউবিক মিটারে আগে খরচ ছিল ২ দশমিক ৮৮ ইউরো, এখন তা ১ দশমিক ৬ ইউরোতে নামিয়ে আনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ঢাকা থেকে নদীপথে সবচেয়ে সহজ ও কম খরচের পথ হচ্ছে পায়রা। এখানে জোয়ার-ভাটার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। নদী স্বাভাবিকভাবেই গভীর। সম্প্রতি পায়রাবন্দরের উন্নয়নে তিনটি নতুন প্রকল্পের জন্য সরকার ৫ হাজার ৩১২ কোটি টাকার প্রস্তাব দিয়েছে। ৩ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রাবনাবাদ চ্যানেলে ড্রেজিং করা হবে। গভীরতা যেন ১০ দশমিক ৫ মিটার থাকে। দুটি হপার ড্রেজার কেনা হবে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় ১৬১ কোটি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনে ৪৯০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
বন্দর কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, এরই মধ্যে ডিআইএসএফ প্রকল্পে প্রশাসনিক ভবন, সড়ক, পুনর্বাসন এলাকা, জেটি নির্মাণ হয়েছে। পিপিএফটি প্রকল্পে চলছে মাল হ্যান্ডলিং, টার্মিনাল ও বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন। দুটি প্রকল্পে ৮৫ থেকে ৯৩ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। অসম্পূর্ণ রয়েছে দুটি কনটেইনার টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল, রেল সংযোগ, শিপ রিপেয়ার ফ্যাসিলিটি ইত্যাদি। মোবাইল হারবার ক্রেন, ট্রেইলর, ট্রাক্টরসহ বেশ কিছু ইকুইপমেন্ট এসেছে। অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর হতে পারবে না। নদীবন্দর হিসেবেই থাকবে। চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প বানাতে গিয়ে অযৌক্তিক অপচয়ে জড়িয়েছে সরকার। কয়লা আনায় কিছু কাজ হতে পারে। বড় জাহাজ সরাসরি ভিড়তে পারবে না।
গবেষণায় দেখা গেছে, বন্দরের নৌপথে বিভিন্ন স্থানে ৫ থেকে ১৫ মিটার গভীরতা আছে। ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাবনাবাদ চ্যানেলকে কার্যকর রাখতে বছরে ১০ কোটি কিউবিক মিটার পলি খনন করতে হবে। খরচ হবে ৮-১০ হাজার কোটি টাকা। বড় ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস হলে চ্যানেল বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা।
চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও পায়রাবন্দর ঘিরে রয়েছে বৃহৎ পরিকল্পনা। পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারত্বে দুটি কনটেইনার টার্মিনাল, একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং লিকুইড বাল্ক টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ রয়েছে। ১ হাজার ২০০ একর জমিতে ৪০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও চলছে। বন্দরের লক্ষ্য ২০৪৩ সালের মধ্যে লাভজনক হওয়া। বন্দর কর্তৃপক্ষের আশা, এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে। কর্মসংস্থান হবে। দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন গতি আসবে। এরই মধ্যে পায়রাবন্দরে বিনিয়োগের জন্য বসুন্ধরা, টিকে, প্রাণ-আরএফএল, মদিনা, এসিআইয়ের মতো গ্রুপ আগ্রহ দেখিয়েছে। চীন, জাপান, ডেনমার্ক, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতারসহ অনেক দেশই পায়রা বন্দরে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।