জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে বেসরকারি খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার কর ফাঁকি ও জাল নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিলের গুরুতর অভিযোগ। কর ফাঁকির পেছনে রয়েছে এস আলম গ্রুপের কাছে শেয়ার হস্তান্তরের আড়ালে করা আন্ডারহ্যান্ড লেনদেন, যা দেশের করব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
কীভাবে ঘটল কর ফাঁকি : ২০১৭ সালে ইউনাইটেড গ্রুপের মালিকানায় ছিল সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) ২২ কোটি ৭৪ লাখ শেয়ার। ওই শেয়ার ব্যাংকটির পর্ষদে নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যবহারের পরিকল্পনা থাকলেও এস আলম গ্রুপের চাপের মুখে ইউনাইটেড গ্রুপ এসব শেয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। প্রতিটি শেয়ারের প্রকৃত মূল্য ছিল ২০ থেকে ২৭ টাকার মধ্যে; অথচ চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের কাছে তা ৪৯ টাকায় বিক্রি করা হয়। এ অস্বাভাবিক দামের ব্যবধানের মাধ্যমে ইউনাইটেড গ্রুপ আনুমানিক ৬০০ কোটি টাকা আয় করে, যার কোনোটিই কর নথিতে দেখানো হয়নি। মূল অভিযোগ, এ আয়ের বিপরীতে ৩০ শতাংশ ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া হয়েছে, যা কর আইনে গুরুতর অপরাধ। আর এ ঘটনার মূলহোতা ছিলেন ইউনাইটেড গ্রুপের তৎকালীন চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) ইবাদত হোসাইন ভূঁইয়া। কারসাজির উপহার হিসেবে তিনিও এসআইবিএলের শূন্য দুই শতাংশ শেয়ারের মালিক ছিলেন। ইবাদত এখন এস আলম গ্রুপে কর্মরত।
কারা জড়িত : এনবিআরের প্রাথমিক তদন্তে যাঁদের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন ইউনাইটেড গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা ৫৫ কোটি, বর্তমান চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনউদ্দিন হাসান রশিদ ২৪ কোটি, সাবেক পরিচালক খোন্দকার মইনুল আহসান ১৯ কোটি ও ফরিদুর রহমান খান ১৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইউনাইটেড গ্রুপের বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে বা ব্যক্তিগতভাবে শেয়ার মালিকানায় ছিলেন আরও অনেক পরিচালক। তাঁরা মিলেই এসআইবিএলের ৩০ দশমিক ৮৮ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতেন।
পারিবারিক ও ব্যবসায়িক যোগসূত্র : অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইউনাইটেড গ্রুপের শীর্ষ পরিচালকের মধ্যে রয়েছে ঘনিষ্ঠ পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক। উদাহরণস্বরূপ, হাসান মাহমুদ রাজার ছেলে মইনউদ্দিন হাসান রশিদ, যিনি শাহজী এন্টারপ্রাইজের এমডি। ফরিদুর রহমান খান, যিনি ফাহাদ খানের পিতা এবং একাধিক সহযোগী কোম্পানির পরিচালক। আহমেদ ইসমাইল হোসাইন ও তাঁর ছেলে মালিক তালহা ইসমাইল বারি উভয়েই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর মালিক ও পরিচালক ছিলেন এখন তাঁরা ইউনাইটেড গ্রুপের সঙ্গে নেই। প্রায় সবাই নেপচুন কমার্শিয়াল, নভো রিয়েল এস্টেট, শাহজী এন্টারপ্রাইজ ও ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
এনবিআরের পদক্ষেপ : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইতোমধ্যে ইউনাইটেড গ্রুপের সব পরিচালকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে। পাশাপাশি তাঁদের সবার আয়কর রিটার্ন ও সম্পদ বিবরণী তলব করা হয়েছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে প্রত্যেককে ‘কারণ দর্শাও’ নোটিস পাঠানো হয়েছে, যেখানে তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে ‘এ বিপুল পরিমাণ করযোগ্য আয়ের কোনো তথ্য কেন রিটার্নে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি?’ লিখিত জবাব না এলে কর আইনের ধারা অনুযায়ী কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে এনবিআর।
রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা : আয় গোপন করে শতকোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়ে ইউনাইটেড গ্রুপ কেবল এনবিআরের নয়, রাষ্ট্রের সঙ্গেও প্রতারণা করেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষকদের মতে এত বড় অঙ্কের ফাঁকি সাধারণ ভুল নয়, এটি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের মাধ্যমে এক প্রকার পরিকল্পিত কর ফাঁকি। পাশাপাশি এস আলম গ্রুপের সঙ্গে করা আন্ডারহ্যান্ড লেনদেন এ প্রশ্ন আরও জোরালো করে তুলেছে। এ ঘটনার মাধ্যমে কর কর্তৃপক্ষ যেমন কর ফাঁকির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, তেমন এটি দেশের করনীতির ভবিষ্যতের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির। তদন্ত চূড়ান্ত হলে ইউনাইটেড গ্রুপ ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা-ই এখন দেখার বিষয়।
এসব বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য ইউনাইটড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মইনউদ্দিন হাসান রশিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।