পাকিস্তান রাষ্ট্রে আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রবাহের তপ্ত হাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে সদস্যদের উপস্থিতি ও আলাপ-আলোচনায় সরাসরি প্রভাব ফেলত। যেমন আইউব খানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যখন ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছিল, তখন প্রতিদিন আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল বিরোধীদলীয় প্রার্থীর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে। ক্লাবে তখন টেলিভিশন এসে গেছে। মনোযোগ দিয়ে আমরা খবর শুনতাম। যদিও তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রীদেরই কেবল ভোটাধিকার ছিল, তবু আমাদের আশা ছিল অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে আইউব খানের হার হবে। যেদিন ফল বের হবে, সেদিন আমরা উদ্বিগ্ন পরীক্ষার্থীর মতো ক্লাবে বসে আছি টেলিভিশনের সামনে। ফল ঘোষণা শুরু হলো এবং আমাদের উদ্বেগ ক্রমশ বিষণ্নতায় পরিণত হতে থাকল। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও ফাতেমা জিন্নাহ হেরে গেলেন। চোখমুখে আমাদের হতাশা ছিল দেখার মতো।
আমার শিক্ষক ড. খান সারওয়ার মুরশিদ তখন রোজই ক্লাবে আসতেন, সেদিনও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর বক্তব্যটি এখনো মনে পড়ে। বলেছিলেন, আকাশে উড়ছিলাম, একেবারে পাতালে পড়ে গেলাম। ওটি ছিল সে সময়ে ক্লাবে উপস্থিত সবারই অনুভূতি।
ওই হতাশা কাটতে সময় লেগেছে। পঁয়ষট্টির যুদ্ধের পরপরই আমি ইংল্যান্ডে যাই উচ্চশিক্ষা লাভের আবশ্যকতায়। দুই বছর আট মাস পরে আটষট্টির জুলাই মাসে দেশে ফিরে ক্লাবে গেছি। অনেকের সঙ্গে দেখা, দুয়েকজন বন্ধু আবার এসেছেন ফিরেছি শুনে দেখা করার জন্য। পরিবেশটি মনে হলো আগের চেয়েও বিষণ্নতায় ভারাক্রান্ত। কেউ কোনো আলোর সন্ধান দিতে পারছেন না। কেউ কেউ দেখলাম বৈষয়িক বিষয়ে আলাপ করছেন। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে অবগত হলাম। বিলেত থেকে আমি একটা গাড়ি এনেছি কি না, জানতে চাইলেন একাধিক হিতৈষী। আনিনি শুনে আমার অবিবেচনায় হতাশই হলেন। দেশে তখন আইউব খানের উন্নয়নমূলক উদ্যাপনের অত্যুৎসাহী উদ্যোগ চলছে।
তার মধ্যেও কাউকে কাউকে পাওয়া গেল যারা আশা ছাড়েননি, আগের মতোই আছেন। সেই সময়েই টের পাওয়া গেল- বাইরে রাজনৈতিক অসন্তোষ বাড়ছে এবং আরও বাড়বে এমন ভরসা করা সম্ভব হচ্ছে। তখন ক্লাবে আমরা যারা সমমনা, তারা মিলিত হই, আলাপ করি কী করা যায়। ওই সব কথাবার্তার ভিতর থেকেই সিদ্ধান্ত বের হয়ে এলো যে প্রশাসনপন্থিদের জবরদখল হটিয়ে দিয়ে শিক্ষক সমিতিকে চাঙা করা দরকার। আমরা ঠিক করলাম সমিতির নির্বাচনে অংশ নেব। প্রফেসর আবু মহামেদ হবিবুল্লাহকে রাজি করানো গেল সভাপতি হতে। নির্বাচনে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো না। আমরা সবাই জিতলাম। এই বিজয়ের ফলে মনে হলো ক্লাবের পরিবেশটি বদলে গেছে।
আইউব খান অতিনিকৃষ্ট একটি কালো আইন চালু করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। শিক্ষক সমিতি থেকে আমাদের দাবি ছিল এই আইন বাতিল করার। দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ওই দাবি উঠেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তখন এ দাবিতে সরব হয়ে ওঠে। আইউববিরোধী আন্দোলন তখন ধীরে ধীরে চাঙা হয়ে উঠছে। ছাত্ররা স্বৈরশাসনবিরোধী যে এগারো দফা দেয় তাতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো আইন বাতিলের দাবি ছিল। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান এগিয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল গুমোট কেটে যাচ্ছে, সামনে একটি ঝড়ের পালা। ওই বছরের শুরুর দিকেই অনেকগুলো ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে সামরিক বাহিনীর হাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহার শহীদ হওয়া। এই ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। জোহা শহীদ হন ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখে, পরের দিন, ক্লাবে শিক্ষক সমিতির প্রতিবাদ সভা ডেকে দিবসটিকে আমরা শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করি। আমি তখন সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা রাজপথে মিছিল করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মিছিল করা বোধ করি ওই প্রথম। ড. হবিবুল্লাহর নেতৃত্বে আমরা নতুন গভর্নর এ কে এম আহসানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে একটি স্মারকলিপি প্রদান করি। আমরা পূর্ববঙ্গের সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বড় একটি সভায় মিলিত হয়েছিলাম। স্থান ছিল ক্লাবের হলঘর। মনে পড়ে, সে সভায় স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে আমি একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। বলা বহুল্য আমাদের সব তৎপরতারই কেন্দ্রীয় দপ্তর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব। আলোচনা, সমাবেশ, পরামর্শ বৈঠক সবকিছু ওইখানেই হতো। এই সময়ে আমরা সমমনা কয়েকজন ঠিক করেছিলাম একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করব। পত্রিকা অবশ্য শেষ পর্যন্ত বের করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু সে নিয়ে আমাদের কথাবার্তাও ক্লাবেই হতো। ক্লাব তখন অত্যন্ত প্রাণবন্ত, সারা দেশের মতোই।
একাত্তরে ২৫ মার্চের আগপর্যন্ত প্রতিদিনই একবার না একবার আমরা ক্লাবে মিলিত হতাম। সভা হতো। কী ঘটতে যাচ্ছে এবং আমাদের কী করণীয়, তা নিয়ে সরবে কথাবার্তা চলত। বিদেশে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য চিঠির খসড়া আমরা ওইখানে বসেই তৈরি করতাম। ক্লাবের একটি কামরা শিক্ষক সমিতিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল কার্যালয় হিসেবে ব্যবহারের জন্য।
শিক্ষকদের এসব তৎপরতার ওপর সামরিক কর্তৃপক্ষের যে চোখ ছিল, সেটি টের পাওয়া গেছে ২৫ মার্চের রাতেই। ওই রাতে আমরা ক্লাব থেকে বাসায় চলে যাই ৮টার পরে। টেলিভিশনের সংবাদে বোঝা গেল যে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি এবং আওয়ামী লীগ ২৭ তারিখে হরতাল ডেকেছে। ওদিকে তখনকার ইকবাল হল থেকে কয়েকজন ব্যস্তসমস্ত ছাত্র এসে জানাল যে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করা হচ্ছে, সামরিক বাহিনী হামলা করবে বলে তাদের আশঙ্কা। আমরা বিষণ্ন মনে যার যার ঘরে ফিরলাম। তারপর মধ্যরাত্রে সেই অবিশ্বাস্য গণহত্যার সূত্রপাত। হানাদাররা ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসে তো তাদের নৃশংসতার প্রমাণ দিয়েছেই, ক্লাবকেও বাদ দেয়নি। সেখানেও ঢুকেছে, যাকে পায় হত্যা করবে বলে। সবাই চলে গিয়েছিল, বেয়ারারদের ভিতর চারজন যেতে পারেনি; সে রাতে ক্লাবভবনেই তারা প্রাণ হারিয়েছে।
ক্লাবের শিক্ষকরা সভা-সমাবেশ করে বলেই হানাদার খুনিদের ওই আক্রোশ। আগস্ট মাসে আমাদের পাঁচজন সহকর্মীকে তারা তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে চারজন আবুল খায়ের, রফিকুল ইসলাম, কে এ এম সা’দউদ্দীন ও এ এন এম শহীদুল্লা ছিলেন পরপর ক্লাবের সম্পাদক; আর আহসানুল হক ছিলেন শিক্ষক সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক। বোঝা যায় ক্লাব ও সমিতিকে হানাদাররা একই চোখে দেখত। ক্লাবে অনুষ্ঠিত সভায় শিক্ষকরা কে কী বলতেন, সে বিষয়েও তারা অবগত ছিল; বন্দি শিক্ষকদের তারা শিক্ষকদের সভার ছবি পর্যন্ত দেখিয়েছে। বোঝা গেছে ক্লাবে গুপ্তচরদের বিলক্ষণ আনাগোনা ছিল।
হানাদারদের আত্মসমর্পণের দুই দিন পর আবার আমরা ক্লাবে ঢুকি। আমাদের মন ভারাক্রান্ত ছিল ১৪ ডিসেম্বর আলবদরদের নৃশংসতায় শহীদ হওয়া সহকর্মীদের হারানোর ব্যথায়। ক্লাবে ঢুকে হল কামরার কার্পেটে দেখলাম রক্তের ছাপ। সম্ভবত ক্লাবের সেই চারজন কর্মীর গায়ের রক্ত, ২৫ মার্চের কালরাতে যারা আটকা পড়ে গিয়েছিল ক্লাব ভবনে। এত বছর পর তাদের নাম স্পষ্টভাবে স্মরণ করতে পারছি না, সে আমার ব্যর্থতা, কিন্তু তাদের চেহারা পরিষ্কার দেখতে পাই। খুবই হাসিখুশি এবং অত্যন্ত বিনয়ী ছিল তারা।
ক্লাবের সঙ্গে এখন আমার আগের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে; কিন্তু ক্লাব যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের অপরিহার্য অংশ, সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সেখানে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন আসতেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে দাবা খেলতে। নূর মোহাম্মদ স্যার আসতেন টেনিস খেলার জন্য। আমরা যেতাম পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে ও কথা বলতে।
এখন ক্লাবও হয়তো ঠিক আগের মতো নেই; তেমন কথা অবশ্য পুরাতনরা সব সময়েই বলে থাকেন নতুনের সম্বন্ধে। ক্লাব নিশ্চয়ই নতুন সময়ের নতুন রকমের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। এবং সেখানে নিয়মিত নির্বাচনও হয়- যেমন ক্লাবের তেমনি শিক্ষক সমিতির, যা নিয়ে ছাত্ররা শিক্ষকদের হিংসা করে। কারণ তাদের সংসদের নির্বাচন অনেককাল হয়নি।
অতিসম্প্রতি অবশ্য শিক্ষার্থীদের সে আক্ষেপ ঘোচার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ঢাবিসহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জোরদার প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ডাকসুর নির্বাচন হতে যাচ্ছে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর। সুষ্ঠুভাবে এ ভোট অনুষ্ঠিত হোক, এবং নিয়মিত এ চর্চা যেন অব্যাহত থাকে সে কামনা করি।
যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার অনেক ঋণ, ক্লাবের কাছেও কম নয়। ওই ঋণ অপরিশোধ্য।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়