সামিটের ব্যবসার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও তাদের কোনো মৌলিক ব্যবসা নেই। বরং অন্য দেশগুলোয় তারা যৌথ অংশীদারি এবং শেয়ার কেনার মাধ্যমে ব্যবসা করে। এ ছাড়া সামিট ইন্টারন্যাশনালের শেয়ার বিক্রি করে বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। অর্থাৎ সামিট গ্রুপের পুরো কার্যক্রম যদি বিশ্লেষণ করা যায়, দেখা যাবে তাদের ব্যবসার মূল কেন্দ্র হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশে যেমন বিদ্যুৎ, টেলিকম, আবাসনসহ অন্যান্য খাতে ব্যবসা করেছে। সেসব সেক্টরেই সামিট বিনিয়োগ করেছে, যেখানে সহজে টাকা উপার্জন করা যায় এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আছে। মজার ব্যাপার হলো, এসব ব্যবসা করতে গিয়ে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে তাদের একটা সমঝোতা হয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ কর রেয়াত পেয়েছে। ধরা যাক বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং কুইক রেন্টালের কথা। সেখানে সামিট সরকারের সঙ্গে এমনভাবে চুক্তি করে যাতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো অলস বসে থাকলেও সামিট টাকা পাবে। অর্থাৎ বিনিয়োগে কোনো ঝুঁকি নেই। একইভাবে যখন তারা টেলিকম ব্যবসা শুরু করে, তখনো শেয়ার বিক্রির জন্য কর রেয়াত পায়। যখন সামিট সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের জন্য কাজ শুরু করে, তখনো তাকে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা। অর্থাৎ সরকারের ছাড়, সুযোগসুবিধা এবং আনুকূল্য ছাড়া সামিট কোনো ব্যবসাই করতে পারেনি। অথচ এ পুরো লভ্যাংশের টাকা চলে গেছে সিঙ্গাপুরে। এ টাকা সিঙ্গাপুর থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কালো টাকা রূপান্তরিত হয়েছে সাদা টাকায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত সামিট গ্রুপের কর্মপরিধি ও কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিদ্যুৎ এবং তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছে। সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেড, এসপিএল লিমিটেডের মাধ্যমে বন্দর ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন আজিজ খান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে প্রতিষ্ঠানটি হয়ে উঠেছিল ড্রাই ডক লিমিটেড (সিডিডিএল) অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল ফ্যাসিলিটিজগুলোর অন্যতম। তালিকাভুক্ত কোম্পানি দেশের রপ্তানি কনটেইনারের ২০ এবং আমদানি পণ্যের কনটেইনারের ৭ দশমিক ৬ শতাংশ হ্যান্ডলিং করত। মুন্সীগঞ্জে এসপিএল লিমিটেডের গড়ে তোলা মুক্তাপুর টার্মিনাল দেশের বেসরকারি খাতে প্রথম অভ্যন্তরীণ নৌ টার্মিনাল ফ্যাসিলিটিজ। এটি করার ক্ষেত্রেও তারা সরকারের সহযোগিতা পেয়েছে। সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ইস্ট গেটওয়ে আই প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে ভারতের কলকাতা বন্দরে জেটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে ব্যবসা করে সেখান থেকে সরকারি সুযোগসুবিধা নিয়ে এবং নানানরকম নয়ছয় করে আবার ভারতের কলকাতা বন্দরে তারা বিনিয়োগ করেছে। এ ছাড়া কোম্পানির সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাবসিডিয়ারি সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট পিটিআই লিমিটেড আন্তর্জাতিক শিপিং কোম্পানি ও ফ্রেড কোম্পানিগুলোর সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চট্টগ্রাম, মুক্তারপুর ও কলকাতা বন্দর ব্যবসায় প্রয়োজনে সরঞ্জাম সংগ্রহ করে এ কোম্পানি। ভারতের পার্টনায়ও একটি বন্দর উন্নয়নের কাজ করছে সামিট। যেটি এখন নির্মাণাধীন। এটা করেছে বাংলাদেশ থেকে লাভের টাকায়। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের ত্রিপুরায় প্রথমবারের মধ্যে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শেয়ার কেনে সামিট। অর্থাৎ পাচারকৃত অর্থ দিয়ে তারা শুধু শেয়ার কেনে। ওএনজিসি ত্রিপুরা পাওয়ার লিমিটেডের ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার কিনেছে সামিট ইন্ডিয়া ত্রিপুরা। তবে এ শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও সামিট একই রকম কৌশল অবলম্বন করেছে। বাংলাদেশ থেকে অর্জিত টাকা সিঙ্গাপুরে জমা হয়েছে এবং সিঙ্গাপুর থেকে তারা ত্রিপুরার ওএনজিসির পাওয়ার প্ল্যান্টের শেয়ার কিনেছে। অথচ এটি বাংলাদেশের টাকায় করা। কিন্তু এতে বাংলাদেশ সরকারের কোনো লাভ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থের ওপর ভর করে ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এবং অন্যান্য বিনিয়োগকারীকে সঙ্গে নিয়ে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন আজিজ খান। পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বিদ্যুৎ প্রকল্পের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জেনারেল ইলেকট্রিকের সঙ্গে চুক্তি করে। এ ছাড়া ফিনল্যান্ডভিত্তিক ওয়াট সিলারের সঙ্গে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে সামিট। বর্তমানে জেরা, জি মিতশুবিসি ও তাইও ইন্স্যুরেন্স সামিটের ইকুইটি হোল্ডারস হিসেবে পরিচিত। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আহরণ এবং রীতিমতো লুণ্ঠনের মাধ্যমে তা সম্পূর্ণ বিদেশে পাচার করে। তার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সামিট গড়ে তুলেছে তার পুরো সাম্রাজ্য। যে টাকা বাংলাদেশের মানুষের রক্তঘামে অর্জিত। কিন্তু সেটির মালিকানা এ দেশের জনগণের নেই।
সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত সামিট ইন্টারন্যাশনাল দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যুৎ এলএনজি অবকাঠামো ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে তাদের কোম্পানি প্রোফাইলে বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে তথ্য হলো, বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন, অবকাঠামো উন্নয়ন বা অন্য কোনো কাজ করে না। তারা শেয়ার কেনার মাধ্যমে ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়। একদিকে যেমন তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা নিয়ে বিপুল মুনাফা করে এবং পুরো অর্থই সরকারের নিয়মকানুন উপেক্ষা করে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দেয়; সিঙ্গাপুরের কোম্পানিতে বিপুল বিনিয়োগ আছে দেখে তারা অন্যান্য কোম্পানিকেও ইকুইটি শেয়ার কেনায় উদ্বুদ্ধ করে এবং সফল হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল ২২ শতাংশ শেয়ার, অর্থাৎ ৩৩ কোটি ডলারের শেয়ার কিনে নেয় জাপানস এনার্জি ফোর নিউ এরা (জেরা)। এতে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন দেড় বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ জাপানি কোম্পানিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শতকোটি ডলারের ক্লাবে প্রবেশ করেন আজিজ খান। এ পুরো প্রক্রিয়াটি করা হয়েছে বাংলাদেশের ব্যবসার টাকায়। অথচ বাংলাদেশ এখান থেকে লাভবান হতে পারেনি।
শুধু সিঙ্গাপুর এবং সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির মাধ্যমে সামিট গ্রুপ তার সাম্রাজ্য বিস্তার করছে বিভিন্ন দেশে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা সংযুক্ত আরব আমিরাত, মরিশাস, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গসহ বিভিন্ন দেশে তাদের সম্পদের পাহাড় গড়েছে। আজিজ খান পরিবারের ১১ সদস্যের প্রত্যেকেরই বিদেশে কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো সম্পদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ সম্পদগুলো সবই বাংলাদেশের টাকা থেকে তারা বিদেশে পাচার করেছেন বলে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত আজিজ খান পরিবার এবং তাঁর বিভিন্ন সদস্যের সম্পদের নানান বিনিয়োগের খবর পাওয়া যায়। আজিজ খান নিজেই সিঙ্গাপুরের নাগরিক। সিঙ্গাপুরে তাঁর সম্পদের তথ্য প্রকাশিত। তাঁর ছোট ভাই মুহাম্মদ ফয়সাল করিম খান সিঙ্গাপুর ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিপুল সাম্রাজ্যের মালিক। সেখানে তাঁর বিপুল পরিমাণ সম্পদ আছে। আঞ্জুম আজিজ খান হলেন আজিজ খানের স্ত্রী। যাঁর সিঙ্গাপুরে একাধিক ফ্ল্যাট এবং সম্পদ রয়েছে। এ ছাড়া মরিশাসে তিনি সম্পদ করেছেন বলে জানা গেছে। আয়েশা আজিজ খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের মালিক হয়েছেন। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিনল্যান্ডে সম্পদের মালিক হয়েছেন। আদিবা আজিজ খানের আরেক মেয়ে যিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড় করেছেন। এ ছাড়া তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডায় সম্পদ গড়েছেন বলে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। এভাবে এ পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের টাকা লুণ্ঠন করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এ অর্থ সবই দেখানো হচ্ছে সিঙ্গাপুরে তাঁদের সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের অর্থ থেকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ব্যবসা শুধু বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশে শেয়ার কেনা এবং শেয়ারে বিনিয়োগ ছাড়া তাদের কোনো ব্যবসা নেই। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের যে ধরনের চরিত্র থাকা উচিত, তার কোনোটাই না থাকার পরও সামিট গ্রুপ বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের লুণ্ঠিত অর্থ দিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছে।