চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ দশমিক ৮ শতাংশ, যা আগাম সংকটের বার্তা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি ও রক্ষণশীল বাণিজ্যনীতির কারণে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির ওপর। আন্তর্জাতিক চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ আয়োজিত বার্ষিক কাউন্সিলে এমন বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএমএফ ও এডিবি বলেছে, এই হার হতে পারে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৮ ও ৩ দশমিক ৯ শতাংশ।’ সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, খাদ্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ। বিনিয়োগ হ্রাস ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে। ২০২৪ সালের শেষে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন টাকা, যার বড় অংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের। ১৯টি ব্যাংক জানিয়েছে ১ দশমিক ৭১ ট্রিলিয়ন টাকার মূলধন ঘাটতির কথা। এ কারণে সরকার ব্যাংক বোর্ড বাতিল, ব্যাংক একীভূতকরণসহ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশে এখন ভালো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। তাঁর মতে, ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ নিয়ে গেছে। ব্যাংক পুনর্গঠনের জন্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার লাগবে বলে জানিয়েছে আইএমএফ। এ ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় তো হয়েছেই, সেই সঙ্গে প্রক্রিয়াগুলোও ধ্বংস করা হয়েছে। তাঁর অভিমত, গত বছরের আগস্টে যখন এই সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন দেখা গেছে এ রকম অবস্থা বিশ্বে কোথাও নেই। অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়েছে। ব্যাংক খাতের ৮০ শতাংশ অর্থ নিয়ে গেছে। ব্যাংকের আউটস্ট্যান্ডিং ২০ হাজার কোটি টাকা হলেও ১৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। আইএমএফ বলেছে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের পুনর্গঠনের জন্য ৩৫ বিলিয়ন ডলার লাগবে। যদিও প্রাথমিক হিসাবে বলেছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার লাগবে। দেশে এখন ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। আইনের ব্যত্যয় তো হয়েছেই, প্রক্রিয়াগুলোও ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু মানুষগুলো তো রয়েই গেছে। অনেকে বলে, সব বাদ দিয়ে দাও। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। এজন্য মাথায় হাত বুলিয়ে, ধমক দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের অভিমত, দেবতুল্য ক্ষমতার একমাত্রিকীকরণ স্বৈরাচারিতার কারণ। ক্ষমতার কলুষিত মডেল বিতাড়িত করতে হবে। স্বাধীনতার পর যে রাষ্ট্র জনগণের হাতে আসার কথা ছিল, তা আসেনি। দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও কুক্ষিগত ক্ষমতার কারণে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হয়েছে। তবে এ কথাও স্বীকার করা দরকার, ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নানান ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কিছু উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের উন্নতি হয়েছে। দেশের রপ্তানি আয় চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
তৈরি পোশাক খাতের মধ্যে নিটওয়্যার রপ্তানি ২৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। ওভেন পোশাক রপ্তানি ২৩ শতাংশ বেড়ে ১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে এবং হোম টেক্সটাইলস খাতে রপ্তানি আয় ১৩ দশমিক ২৪ শতাংশ বেড়ে ৬৮ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে তৈরি পোশাকশিল্প। এই শিল্প দেশীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মোট প্রবৃদ্ধির ৬-৮ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক কমার বিষয়টি গার্মেন্টশিল্পসহ ব্যবসায়ীদের জন্য স্বস্তির । কারণ বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া সব পণ্যের ওপর আগে থেকেই গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। এর সঙ্গে পাল্টা ৩৫ শতাংশ শুল্ক যোগ হলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে ৫০ শতাংশ শুল্ক গুনতে হতো। সেখানে এখন পুরাতন ১৫ শতাংশ এবং নতুন ২০ শতাংশ মিলিয়ে মার্কিন বাজারে মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। এদিকে ভারতের পণ্যে ৫০ শতাংশ শুল্কারোপের ফলে বাংলাদেশ কৌশলগত সুবিধা পেতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি দরকার বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার আলোকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ।
লেখক : সাংবাদিক