যখন আমরা শহরমুখী প্রবণতার কথা বলি, তখন গ্রামে থাকা একজন তরুণ যদি স্বপ্ন দেখেন কৃষিকে ঘিরে, আর সেই স্বপ্ন বাস্তবেও রূপ দেন; তবে তা হয়ে ওঠে নতুন প্রজন্মের জন্য এক অনুপ্রেরণার গল্প। ঠিক তেমনই একজন হলেন নরসিংদী জেলার পারুলিয়া গ্রামের স্বাধীন চৌধুরী। বয়সে তরুণ, কিন্তু চিন্তায় পরিণত। বাবার কাছ থেকে পাওয়া মাত্র দেড় লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেছিলেন কোয়েল লালনপালন। আজ তার খামারে কোয়েলের সংখ্যা ৫৫ হাজার। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
স্বাধীনের এই সাফল্য এক দিনে আসেনি। শুরুর সময়টা ছিল ভীষণ চ্যালেঞ্জিং। একদিকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির চাপ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। লোকে বলেছে, স্বাধীনের পাখি দেবে ফাঁকি। কিন্তু থেমে যাননি তিনি। পাশে পেয়েছেন পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং গণমাধ্যমের উৎসাহ। মূলত গণমাধ্যমের অনুপ্রেরণা বন্ধুর পরামর্শেই শুরু করেন কোয়েল পালন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন একজন সফল খামার মালিক।
বর্তমানে খামারে সাধারণত তিনটি ধাপে কোয়েল লালনপালন করা হয়।
প্রথম ধাপ হলো : ডিম ফোটানো ও বাচ্চা উৎপাদন। সাধারণত ১৬ থেকে ১৮ দিনে ইনকিউবেটরে ফোটে কোয়েলের ডিম, যেখানে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা যথাযথ রাখতে হয়। এরপর শুরু হয় ব্রুডিং, অর্থাৎ বাচ্চা বড় করার প্রক্রিয়া। প্রথম সপ্তাহে তাপমাত্রা রাখতে হয় ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো এবং দিতে হয় ২৪ ঘণ্টা আলো। তৃতীয় ধাপে আসে গ্রোয়ার ও লেয়ার পর্যায়, যেখানে পাখিগুলো হয়ে ওঠে বিক্রয় উপযোগী। পুরুষ পাখি মাংসের জন্য, আর স্ত্রী পাখি ডিম দেওয়ার জন্য বিক্রি হয়।
স্বাধীনের খামারই এখন শুধু নয়, এই উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের গ্রামেও। তার বন্ধু ইয়ামিন, যিনি প্রথম তাকে এই পথে অনুপ্রাণিত করেন, তিনিও গয়েশ্বর গ্রামে একটি খামার পরিচালনা করছেন। শুধু কোয়েল পালন নয়, তারা দুজন মিলে এখন কাজ করছেন কোয়েল মাংস প্রসেসিং নিয়েও। স্থানীয় তরুণদের জন্য এটি একটি উদাহরণ তৈরি করেছে। এখন অনেকেই ভাবছেন শুধু ডিম বা মাংস উৎপাদন নয়, ব্র্যান্ডিং, বাজারজাতকরণ ও ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যের দিকেও দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।
পারুলিয়া গ্রামে বর্তমানে স্বাধীনের তিনটি খামার রয়েছে। যে যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ৫ হাজার কোয়েল নিয়ে, এখন তা রূপ নিয়েছে ৫৫ হাজার পাখির বিশাল খামারে। তার সাফল্যের পেছনে আছে পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং শেখার আগ্রহ। তিনি বুঝেছেন, এই খাতের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সঠিক প্রশিক্ষণ, পরিচ্ছন্ন বাজারব্যবস্থাপনা এবং উদ্যোক্তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমে।
কোয়েল পালন তুলনামূলকভাবে কম জায়গায় করা যায় এবং এর খরচও তুলনামূলকভাবে কম। পাশাপাশি উৎপাদন সময়ও কম হওয়ায় তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এটি হতে পারে লাভজনক ও টেকসই পেশা। তবে চ্যালেঞ্জ রয়েছে, রোগ প্রতিরোধ, খাদ্যের মান, বাজারের দামে ওঠানামা এবং সঠিক বিপণন কৌশলে। স্বাধীন ও ইয়ামিন এখন এই চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে রেখেই ভাবছেন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা।
গবেষকরা বলেন, কোয়েলের একটি ক্ষুদ্র ডিমে যে পরিমাণ প্রোটিন আছে একটি বড় আকারের মুরগির ডিমেও প্রায় সেই পরিমাণ প্রোটিন রয়েছে। অথচ দামের দিক থেকে একটি মুরগির ডিমের দামে প্রায় চারটি কোয়েলের ডিম পাওয়া যায়। আবার কোয়েলের মাংসও পুষ্টিকর। এ কারণে, দেশে পুষ্টির চাহিদা পূরণে কোয়েল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশে কোয়েল লালনপালন দিন দিন জনপ্রিয় ও লাভজনক হয়ে উঠছে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এর পেছনে রয়েছে একাধিক অর্থনৈতিক ও বাস্তবিক সুবিধা। প্রথমত কোয়েল খুব দ্রুত বাড়ে। মাত্র পাঁচ-ছয় সপ্তাহ বয়সেই ডিম দেওয়া শুরু করে এবং বছরে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০টি ডিম দেয়। তুলনামূলকভাবে এরা মুরগির চেয়ে ছোট হওয়ায় অল্প জায়গায় অনেক কোয়েল পালন করা যায়। ফলে শহরাঞ্চলের বাসাবাড়ি বা ছাদেও ছোট পরিসরে খামার গড়ে তোলা সম্ভব। দ্বিতীয়ত কোয়েলের খাবার খরচও কম এবং বাজারে সহজলভ্য, ফলে উৎপাদন ব্যয় থাকে সীমিত। এ ছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হওয়ায় মৃত্যুর হার কম এবং ওষুধ বা চিকিৎসা বাবদ খরচও কম পড়ে।
বাংলাদেশের বাজারে কোয়েলের ডিম ও মাংসের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ডিম ছোট হলেও প্রোটিন ও পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় বিশেষ করে শিশু, রোগী ও স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের কাছে এটি প্রিয় হয়ে উঠছে। অনেকে কোয়েলের মাংসকে ‘ডেলিকেসি’ বা সুস্বাদু খাবার হিসেবে বিবেচনা করছেন। কোয়েল খামার স্থাপন করতে বড় বিনিয়োগ বা জমির দরকার নেই। মহিলারাও এটি বাড়িতে সহজে পরিচালনা করতে পারেন, যা গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত সৃষ্টি করেছে। সব মিলিয়ে কম পুঁজি, কম জায়গা, দ্রুত উৎপাদন, সহজ বাজারজাতকরণ ও উচ্চ চাহিদার কারণে কোয়েল লালনপালন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি লাভজনক ও টেকসই খামার ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।
পাঠকের মনে থাকতে পারে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার পলাশের চর গ্রামের আনোয়ারা খানম ডলির কথা। যার গল্প তুলে ধরেছিলাম আপনাদের সামনে। উদ্যমী নারী ডলি শখ থেকে শুরু করে হয়ে উঠেছেন বড় একজন উদ্যোক্তা। শখে আনা দুটি কোয়েল পাখি থেকে সূচনা হয় এক সমৃদ্ধির গল্প। সে সমৃদ্ধিই ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রামে। তার বাড়ির নিচতলায় ইনকিউবেশন ইউনিট। উদ্যোক্তার ভাষায় এখানেই ‘বীজ ডিম’ থেকে কোয়েলের বাচ্চা উৎপাদন করা হয়। বাড়ির তিনতলায় চলছে কোয়েল পাখির ব্রুডিং। কোয়েল এ পরিবারটির অর্থনৈতিক ভীত তৈরি করেছে। পাশাপাশি গ্রামের অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে তাদের খামারে। আবার ডলিকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন গ্রামের অনেক নারী। গ্রামের বেশ কয়েকটি কোয়েল খামার ঘুরে দেখলাম। কথা বললাম, দুয়েকজন নারী উদ্যোক্তার সঙ্গেও। ঘরে বসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারায় তারা খুব উৎফুল্ল। কেউ গৃহিণী, কেউ বা লেখাপড়ার পাশাপাশি কোয়েল লালনপালন করছেন। তারা বলছেন, কোয়েল লালনপালনের মাধ্যমে সংসারের হাল ধরতে পেরেছেন, লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছেন। চাকরি না খুঁজে নিজে স্বাবলম্বী হতে পারছেন। ঠিক যেমন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন আনোয়ারা খানম ডলিকে দিয়েছে অন্যরকম এক শক্তি। যা তার স্বপ্নের পরিধিকে করেছে বিস্তৃত।
স্বাধীন ও ইয়ামিনের গল্পও শুধু দুটি খামার কিংবা দুজন তরুণের উদ্যোগের নয়। এখানে আছে আত্মনির্ভরতার শিক্ষা, সাহসিকতার পাঠ এবং একটি জটিল ব্যবস্থার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসার গল্প। তারা হয়ে উঠেছেন গ্রামের যুবকদের স্বপ্ন দেখার মানুষ। তাদের চোখে এখন আরও বড় স্বপ্ন নিজেদের খামারকে শিক্ষণীয় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা, যেখানে আরও অনেক তরুণ শিখবে, গড়বে এবং বদলে দেবে তাদের নিজের জীবন আর দেশের কৃষি। এই গল্প আমাদের শেখায়, গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন তরুণের হাত ধরেও বদলে যেতে পারে দেশের কৃষিব্যবস্থার চিত্র। শুধু পুঁজি নয়, প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, নিরলস পরিশ্রম এবং নতুন কিছু করার আগ্রহ। স্বাধীন চৌধুরী ও ইয়ামিন দেখিয়ে দিয়েছেন, ইচ্ছাশক্তি থাকলে সীমাবদ্ধতাই হয়ে ওঠে সম্ভাবনার ভিত্তি। তারা কৃষিকে পেশা ও প্যাশন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বর্তমান সময়ে যখন অধিকাংশ তরুণ শহরমুখী, তখন এই দুই যুবকের গ্রামকেন্দ্রিক এই উদ্যোগ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা বোঝাতে পেরেছেন, কৃষিকাজ মানে শুধু মাঠে হালচাষ নয়, এটি হতে পারে প্রযুক্তিনির্ভর, আধুনিক, বিজ্ঞানভিত্তিক এবং লাভজনক উদ্যোগ। আরও বড় কথা, এটি হতে পারে আত্মমর্যাদার পথ। এখন সময়, স্বাধীনদের মতো উদ্যোক্তাদের আরও উৎসাহিত করার। প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সহযোগিতা, প্রশিক্ষণের সুযোগ এবং বাজারব্যবস্থার উন্নয়ন। পাশাপাশি, গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা ও সঠিক নীতিনির্ধারণ থাকলে দেশের আনাচকানাচে এমন আরও অনেক ‘স্বাধীন’ তৈরি হবে। একটি কোয়েলের খামার থেকেই শুরু হতে পারে একটি গ্রামের অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণ, তৈরি হতে পারে কর্মসংস্থান, আর জেগে উঠতে পারে তরুণদের আত্মবিশ্বাস।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব