‘নিকৃষ্ট লোকরা উৎকৃষ্ট পদে বসে বসে অনাচার করছে। এদের ঝেঁটিয়ে দূর করা ছাড়া দেশ এগোতে পারবে না।’- এরকম অভিমত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ করতেন মানিক মামা, মানে মায়ের মামাতো ভাই ড. সা’দত হুসাইন। অখণ্ড পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসের সর্বশেষ সদস্য পদ অর্জনকারীদের একজন আমার এই মামা তাঁর আত্মীয়দের অপ্রিয় ছিলেন অনড় ন্যায়নিষ্ঠার কারণে। আমলাতন্ত্রে যাকে বলা যায়, ‘রাজাদের রাজা’ সেই পদটি কেবিনেট সচিব। মানিক মামা ওই পদধারী হওয়ার পর বাঁকাপথে সুবিধা হাসিলের মতলবে নানাজন নানা কৌশল অবলম্বন করতেন। একটা কৌশল ছিল ‘সাহেবের আত্মীয়কে হাত করে সাহেবের মন গলানো।’ কোনো কৌশলেই ফলোদয় হতো না। ব্যর্থকাম আত্মীয় তখন ক্ষোভ উগরে দেন- ‘বাপ রে বাপ। কী দেমাগ! হ্যাতে লাগে য্যান্ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট অই গেছে। ঠিক আছে, আঁর আবদার না রাইখলে না রাইখবি। সেই জন্য “এরকুম ফাউল কাম নিয়া কখ্খনো আর আইসবা না” কইয়া বেইজ্জতি করবি?’
বিস্ময়মাখানো প্রশ্নটি উচ্চারিত হতো ড. সা’দত হুসাইনের আড়ালেই। সামনাসামনি উচ্চারণ ছিল বিপজ্জনক। নিজ কৈশোর-যৌবনের বিভিন্ন সময় তাঁর কাছাকাছি থেকেছি। দেখেছি, পাঠ্য বিষয় অগ্রাহ্য করে টানা ছ’সাত দিন শুধু উপন্যাস পড়ছেন। পড়ছেন কঠিন কঠিন নন-ফিকশন। কিংবা ধুমসে খেলছেন ব্যাডমিন্টন আর ভলিবল। ঢাকা কলেজ হোস্টেল থেকে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ছেন, যাচ্ছেন ‘বলাকা’য়- সবান্ধব দেখছেন ছায়াছবি ‘দ্য গান্স অব নাভারণ’। মানুষের দুঃখকষ্ট সংকটমোচনে যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন। প্রায়-তুমুল আড্ডা দিতেন এবং পরীক্ষায় প্রায়-হিরন্ময় রেজাল্ট করতেন। প্রিয় শিল্পীর গাওয়া গান লজ্জার পরোয়া না করে সোচ্চার গাইতেন। বিশেষভাবে গাইতেন ‘যাবার বেলায় পথিক যখন পিছন ফিরে চায়/ফেলে আসা দিনকে ভেবে মন যে ভেঙে যায়।’
ঝেঁটিয়ে দূর করা যে খুবই দরকার, তাতে সন্দেহ নেই। ঝাঁটা হাতে এগিয়ে আসতে কারও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এটা করা উচিত, ওটা করা অন্যায়, সেটা করা পুণ্য তো সহজে বলা যায়। কাজের কাজ কোথায়?- বলেছি আমি। মানিক মামা বলেন, এই যে নিবন্ধের ভাষায় প্রশ্ন তুললি, এটাই সমস্যা। ঝাঁটা হাতে নিজে তেড়ে যাওয়ার চিন্তা যিনি করেন তার মাথায় আবার একটা দুশ্চিন্তাও দোল খায়- নিকৃষ্ট অথচ শক্তিমান ব্যক্তিদের পান্ডারা আমায় চিড়ে চ্যাপ্টা করার জন্য ঝাঁটা হাতে ছুটে আসবে না তো! সেজন্য দেখবি সমাজমঙ্গল যার দ্বারা হওয়া সম্ভব বলে আমরা ভাবি, কালক্রমে সে নিজেকে অপদার্থের শিরোমণি প্রমাণ করে। কিন্তু সমাজজীবন তো গভীর পাষাণের ভিতর ছুটন্ত সুপ্ত স্রোতের মতো। বয়ে যাচ্ছে বয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে। এরই মধ্যে মহাকাল শুরু করে দেয় তার কাজ। যার কথা স্বপ্নেও কেউ ভাবেনি, দেখা গেল সে-ই সাফ করতে শুরু করেছে জঞ্জাল। সাধারণ মানুষ যোগ দিয়েছে তার সেই অভিযানে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের অভিযান এভাবেই এগিয়ে চলে।
দেশহিতৈষণা ছিল তাঁর অন্তরাত্মার অংশ। বলতেন, ‘দেশের জন্য ভালো কিছু করার আকাঙ্খাই যথেষ্ট নয়। ভালো কিছু করবার জন্য চাই জ্ঞান। লেখাপড়া ছাড়া সেই জ্ঞান হয় না। কুসংস্কার মুক্তি ব্যতিরেকে সমাজ অগ্রসরতা অসম্ভব। কুসংস্কারের জনক হচ্ছে ভয়। ভয়কে জয় করে জ্ঞান।’ টেলিভিশনের টক শোতে এ ধরনের কথা প্রায়ই বলতেন ড. সা’দত। বৈঠকী আড্ডায়ও বলতেন। যে কোনো বিষয়ে প্রাণবন্ত ছিল তাঁর আলোচনা। তাই তাঁকে স্মরণ করার পর্যায়ে অনেক সময় ভুলেই যাই যে ২০২০ সালের ২২ এপ্রিল ড. সা’দত হুসাইনের জীবনাবসান হয়েছে।
নিষ্কলুষ রচনা : সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর মানিক মামা বেসরকারি একটি ব্যাংকের ‘উপদেষ্টা’ হয়েছিলেন। তিনি চাইতেন লেখাপড়া জানা স্মার্ট তরুণরা এসে ব্যাংকিং সেক্টরকে শাব্দিক অর্থেই উন্নত ও গতিশীল করুক। প্রতিভা সন্ধানে নেমে ‘কথাবার্তায় খুব স্মার্ট/কলম ধরলে ধুস্ কাৎ’ অবস্থা দেখে কাতর হয়েছেন ড. সা’দত হুসাইন। টেলিভিশনের টক শোতে তিনি বলেন : চাকরি পাই না/চাকরি কেউ দেয় না, এই হা-হুতাশ তো সমাধান নয়। চাকরির যোগ্যতা ধারণ গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য বলছি, যে তরুণ শুদ্ধভাবে এক পাতা ইংরেজি আর এক পাতা বাংলা লিখতে পারবে, গ্যারান্টি দিচ্ছি তার চাকরির ব্যবস্থা আমিই করে দেব।
মতিঝিলে যে প্রতিষ্ঠানে সাত বছর কর্মরত ছিলাম, সেখানে একবার লোকবল সংগ্রহ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছিলাম। লিখিত পরীক্ষায় সুদর্শন এক যুবকের দীনদশায় মর্মাহত হই। মৌখিক পরীক্ষার সময় তাকে সেটা জানাই। যুবক জানায়, সে ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করেছে। তা-ই বাংলায় তার দুর্বলতা খুবই স্বাভাবিক। মৌখিক পরীক্ষক ছিলাম তিনজন। এক পরীক্ষক সরাসরি যুবকটির পক্ষ নিয়ে প্রস্তাব করে- হাতিরঝিল ‘বিষয়ক যে রচনাটি বাংলায় লিখতে বলা হয়েছিল, সে বিষয়টি একে ইংরেজিতে লিখতে দেওয়া হোক। তার প্রস্তাব অনুমোদিত হলো। তাকে বলা হয়, ইংরেজি রচনার জন্য সময় বরাদ্দ পাঁচ মিনিট। লেখালেখির জন্য তাকে আলাদা কামরায় পাঠিয়ে অন্য প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা অব্যাহত রাখা হয়। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এটা চলে। শেষ হলে আমরা ইংরেজি মাধ্যমের সেই প্রার্থীকে ডাকতে উদ্যত হলাম। অফিস সহকারী মান্নান জানায়, ‘ওই স্যার ইংরেজি লেখা উত্তরপত্রটিতে বেশ কয়েকবার লিখেছেন আর লেখা কেটেছেন। আবার লিখেছেন। আবার কেটেছেন। প্রায় আধা ঘণ্টা কাটাকুটি করার পর “ধ্যাত্তেরি” বলে খাতা আমার হাতে দিয়ে চলে গেছেন।’
‘চলে যাওয়ার সময় আমাদের জানালে না কেন?’ প্রশ্নের জবাবে মান্নান নিরুত্তর। পরে অন্য অফিস সহকারীদের বুলেটিনে জানা যায়, সুদর্শন যুবকটি তার প্রস্থান ঘটনা চেপে যাওয়ার জন্য ‘ধরেন, চা-পানি খাইয়েন’ বাবদ পঞ্চাশ টাকার একখানা নোট দিয়েছিল। ঠাকুরগাঁওয়ের সন্তান মান্নান সরলসিধা মানুষ। সুন্দর চেহারার ভদ্রলোক তাকে সম্মান করে টাকা দিচ্ছে, উনারে মানা করতে লজ্জা হচ্ছিল। সহকর্মীরা তাকে ঘুষখোর বলবে জানলে সে ওই নোট ছুঁয়েও দেখত না।
খতরনাক : সহকর্মীদের আচরণ পীড়াদায়ক ছিল মান্নানের জন্য। ‘সম্মান’ করেছিলেন যে চাকরিপ্রার্থী তার ব্যবহারও রহস্যময়। শিক্ষিত ভর্দলোকদের ব্যাপারস্যাপার কবে যে সাফ সাফ বোঝা যাবে আল্লাহ মালুম। ইংরেজি মাধ্যমের প্রার্থীর রচনা পাঠ করতে করতে পরীক্ষকদের হাসাহাসি আর মন্তব্যদৃষ্টে (এসএসসি পাস) মান্নান উপলব্ধি করে, ইংরেজিতে ওই সাহেবের দখল আর ক্লাস ফাইভে পড়া স্টুডেন্টের ইংরেজি বিদ্যার মধ্যে ফারাক খুব সামান্য। এই লজ্জায় সাহেব চুপিসারে চলে যাওয়ার বুদ্ধি করেছেন, ভালোই করেছেন। তো খাতাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চম্পট হলেন কার বুদ্ধিতে। খাতা নিয়ে যেতে পারতেন নিজের সঙ্গে। তাইলে তো উনার ভাষার দুর্বলতা পাবলিকে টের পেত না। উনার তো জানার কথা, পাবলিকের মতো খতরনাক জিনিস খুব কমই হয়।
বিদ্যায় ফুটোক্লিষ্ট ডিঙি কিসিমের লোকদের অনেকেরই স্বভাব নিজেকে জাহাজ বলে জাহির করা। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের এক লেখায় রজত রায় চৌধুরী নামক ধনপতির দেখা পাই; যিনি কথায় কথায় ‘ইয়েস, নো, ভেরি গুড, অবকোর্স, থ্যাংক ইউ, ম্যান ইজ মর্টাল, গড ইজ গুড’ উচ্চারণ করেন। আগে এরকম ছিলেন না। ব্যারিস্টারি পড়বার জন্য বিলেত গিয়ে পাঁচ বছর পরে অ-ব্যারিস্টার হিসেবে কলকাতায় প্রত্যাবর্তন তাকে দিয়ে ইয়েস-নো-ভেরি গুড করিয়ে নিচ্ছে। ৩৫ বছর বয়সি রজত এখনো অকৃতদার। তার বিয়ের আয়োজন চলছে। পাত্রী খোঁজা হচ্ছে। সন ১৯৬২। দুই ডজন মেয়ে দেখার পর রেখা নামে এক কন্যা পছন্দ হয়। রেখা তার কাকার সঙ্গে মাদ্রাজে বাস করে। দুপক্ষের মধ্যে মতবিনিময় হয় কলকাতায়। ‘ভেবে দেখি’ বলে কনের কাকা সেই যে মাদ্রাজ গেল, আর সাড়া নেই। সঞ্জীবের পিতামহের পরামর্শে রজত চিঠি লেখে রেখার কাকাকে। কিন্তু তিন সপ্তাহেও জবাব আসে না। এবার চিঠি দিলেন রজতের বাবা সূর্যকান্ত রায় চৌধুরী। চটজলদি জবাব এলো। কনের কাকা লিখেছেন, ‘রজতের জঘন্য ইংরেজি পত্র পাঠান্তে অন্তর যারপরনাই বিষণ্নতায় আক্রান্ত। সে এত গাধা! তাহার পত্রখানা ফেরত পাঠানো যাইত। তবু পাঠাইলাম না। কারণ কলকাতা নগরীতে এখনো যে হাজার তিনেক ইংরেজ রহিয়াছে, উহারা রজতের ইংরেজি পড়িয়া সীমাহীন বেদনায় আত্মহত্যা করিয়া ফেলিবে আশঙ্কা করি।’
আফসোস বেদনায় কান্না : মফস্বল শহরে যে এলাকায় আমার বাড়ি, সেখান থেকে মাইল তিনেক পূর্ব দিকের গ্রাম মাসুমপুর। এই গ্রামের খাদেম আলী বছর দশেক নিরুদ্দেশ থাকার পর ফিরে এলো ঘরে। এত দিন সে নাকি লন্ডনে ছিল। বিস্তর রোজগার করে ফিরেছে। কন্যাদায়গ্রস্তরা তাকে জামাই করার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। খাদেম পছন্দ করে সিদ্দিক মাস্টারের মেয়েকে। মেয়েটির বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল আরেক মাস্টারের ছেলের সঙ্গে। পাত্রটি জুট মিলের সুপারভাইজার। ওই সম্বন্ধ বাতিল করে ‘অনেক টাকার মালিক’ খাদেমের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। মাস দেড়েকের মধ্যে সিদ্দিক মাস্টার টের পেলেন ‘শতদল ভাসিয়ে জলে/শামুকের মালা পরেছি গলে’ অবস্থা হয়েছে তাঁর।
শ্বশুরবাড়িতে হানা দিয়ে খাদেম আলীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ডাকাত দলের সদস্য সে। ডাকাতি ও খুনের হাফ ডজন মামলা তার বিরুদ্ধে। আমার এসএসসি পাসের বছরে এই ঘটনা। তখন ন্যাপ নেতা মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ বলেছিলেন, খাদেমরা রাজনীতিতেও আছে। তাদের চিনে রাখতে হবে। ওদের ওপরটা দেখে মুগ্ধ হই আমরা। পরে আফসোস বেদনায় কাঁদি। শুনেছি, খাদেম আলীর স্ত্রীর কান্নাও শোনা গেছে বহু দিন। সে নাকি বিলাপ করত ‘হায় রে কপাল। আমার পেটে যে ডাকাতটার বাচ্চা দিয়া দিলারে খোদা!’
লেখক : সাংবাদিক