গত এপ্রিলের মাঝামাঝি এক ভোরে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। গন্তব্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। নাম মাসকাটা। অবস্থান বাগেরহাট জেলার ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নে। সেই গ্রামের এক তরুণ কামরুজ্জামান সোহেল বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলেন তাঁর গ্রামে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে। সম্প্রতি তিনি এক ভিন্ন রকম উদ্যোগের সূচনা করেছেন। বয়সে তরুণ, আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন, কিন্তু মনের গভীরে লালন করেন কৃষি নিয়ে স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন সার্থক করে তুলতেই তিনি হাত দিলেন এক সাহসী কাজে। নিজ গ্রামে শুরু করেছেন লং বাসমতী-১১২১ ধানের পরীক্ষামূলক চাষ।
দেশে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার সুগন্ধি বাসমতী চাল আমদানি করা হয়। মূলত বিরিয়ানি বা পোলাওয়ের মতো অভিজাত খাদ্য তৈরির জন্য এই চালের ব্যবহার ব্যাপক। দামও প্রচলিত চালের তুলনায় বহু গুণ বেশি। কিন্তু এত দিন দেশে এ জাতের ধান চাষের উদ্যোগ ছিল না বললেই চলে। সেই অভাব পূরণের স্বপ্নই দেখেছিলেন সোহেল।
রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালে গিয়ে হাজির হলাম সবুজ-শ্যামল গ্রাম মাসকাটে সোহেলের বাড়িতে। কৈশোরে বাবাকে হারিয়ে দুই ভাইকে নিয়ে এক সংগ্রামী মায়ের সন্তান তিনি। কৃষিই ছিল তাঁদের একমাত্র অবলম্বন। এ বাস্তবতা থেকেই কৃষির প্রতি সোহেলের অনুরাগ। এলএলবির ছাত্র হয়েও কৃষিকে সঙ্গী করেই এগিয়ে চলেছেন তিনি। কয়েক বছর ধরে নিজের জমিতে হাইব্রিড ধানের আবাদ করলেও লাভজনক ফল পাননি। তখনই তাঁর মাথায় আসে বিদেশি বাসমতী ধানের কথা।
নানা রকম অনুসন্ধান ও ইন্টারনেট ঘেঁটে তিনি আবিষ্কার করেন লং বাসমতী-১১২১ জাতটি বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ ও সুগন্ধি চাল হিসেবে পরিচিত। নয়াদিল্লির ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট (IARI)-এর ল্যাব থেকে উদ্ভাবিত এ জাতটি উন্নত সংকরায়ণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। রান্নার পর এ চালের দৈর্ঘ্য প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। সোহেলের ভাই একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করেন। চাকরিসূত্রে ভারত যাওয়ার সুযোগ হলে তিনি ভাইকে অনুরোধ করেন বাসমতী-১১২১ ধানের বীজ নিয়ে আসতে।
সোহেল ১০ কেজি বীজ সংগ্রহ করে নিজেই বীজতলা তৈরি করেন। এরপর এক একর জমিতে রোপণ করেন। খরচ হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। ফলন পান বিঘাপ্রতি ২৫-৩০ মণ। তবে হাইব্রিডের মতো বেশি উৎপাদন না হলেও বাজারমূল্য দিয়ে সবকিছু পুষিয়ে গেছে। কারণ প্রতি কেজি বাসমতী চালের দাম বাজারে প্রায় ৩৫০-৪০০ টাকা। ফলে একরপ্রতি সম্ভাব্য আয় প্রায় দেড় লাখ টাকা। এ যেন কৃষিতে সুগন্ধি স্বপ্নের বাস্তব রূপ। এ সফলতার খবর ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। খুলনা, যশোর এমনকি বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলা থেকে কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তারা ছুটে আসছেন মাসকাট গ্রামে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সোহেলের বাড়ির সামনের মাঠে কাটা ধান স্তূপ করে রাখা হয়েছে। মাড়াইয়ের কাজ চলছে। দূর থেকেও ধানের সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। সোহেল ধান থেকে চাল ভাঙিয়ে আমাদের হাতে তুলে দেন। সেই চাল শুধু ঘ্রাণেই নয়, দেখতেও ছিল আকর্ষণীয়।
আমাদের আগমনে সোহেলের উঠোনে আয়োজন করা হয় বাসমতী চালের কাচ্চি বিরিয়ানি রান্নার। রান্নার সময় চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে অপূর্ব এক ঘ্রাণ। রান্না শেষে সবাই স্বাদ নিই সেই বিরিয়ানির। প্রতিটি দানায় ছিল সাফল্যের সুবাস। সোহেলের এ প্রয়াস শুধু ব্যক্তি উদ্যোগ নয়, এটি এক অঞ্চলের কৃষির গতিপথ বদলে দেওয়ার সম্ভাবনাময় দৃষ্টান্ত। এ অঞ্চলে লবণাক্ততা একটি বড় সমস্যা। তাই কৃষি বিভাগ ইতোমধ্যেই সোহেলের জমির মাটি সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্ট শুরু করেছে। এ জাতটি যদি লবণসহিষ্ণু হয় তবে দক্ষিণাঞ্চলে এক নতুন সোনালি বিপ্লবের জন্ম দিতে পারে।
যত দূর জেনেছি এটা দক্ষিণাঞ্চলে প্রথম বাসমতী আবাদ। এ উদ্যোগের মাধ্যমে বুঝতে পারি, শুধু সরকারি প্রকল্প নয়, ব্যক্তি পর্যায়ের চিন্তা-চেতনা, গবেষণা ও ঝুঁঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণও দেশের কৃষি অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। বাংলাদেশে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বাসমতী চাল আমদানি করা হয়। যদি সোহেলের মতো তরুণ উদ্যোক্তারা দেশেই এ জাতের ধান চাষে এগিয়ে আসেন, তবে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, দেশের কৃষক লাভবান হবেন এবং ধীরে ধীরে আমরা হয়ে উঠতে পারি বাসমতী চালের রপ্তানিকারক।
তবে এর জন্য প্রয়োজন সরকারি সহায়তা, গবেষণা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। বীজের মান নিশ্চিত করা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাচাই, মাটির উপযোগিতা বিশ্লেষণ এসব কিছুই করতে হবে সুনির্দিষ্টভাবে। প্রয়োজন হলে দেশেই বাসমতীর অনুরূপ জাত উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিতে হবে।
একজন তরুণের হাত ধরে যদি একটি অঞ্চলের কৃষিতে এমন সম্ভাবনার আলো জ্বলে ওঠে, তবে তা সারা দেশের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। কামরুজ্জামান সোহেল প্রমাণ করেছেন, কৃষি কেবল মাঠে লাঙল ধরার বিষয় নয়, বরং এটি হতে পারে গবেষণা, বুদ্ধিমত্তা, পরিকল্পনা এবং সবচেয়ে বড় কথা সাহসিকতার ফসল। মনে পড়ে হরিপদ কাপালির কথা। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আসাদনগর গ্রামের এক প্রান্তিক কৃষক হরিপদ কাপালির হাত ধরে জন্ম নেয় ‘হরি ধান’ নামের এক নতুন ধানের জাত, যা এখন স্থানীয়ভাবে বিপুল জনপ্রিয়। প্রায় ছয়-সাত বছর আগে হরিপদ তাঁর জমিতে বিআর১১ জাতের ধান চাষের সময় কয়েকটি অজানা ধান গাছ দেখতে পান। আগাছা ভেবে ফেলেননি, বরং আগ্রহ নিয়ে রেখে দেন। পরের বছর সেই গাছের ধান আলাদা করে চাষ করে তিনি লক্ষ করেন, ফলন অন্য ধানের তুলনায় অনেক ভালো। ধীরে ধীরে প্রতিবেশী কৃষকদের মধ্যে সেই ধানের বীজ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ফলন ভালো, খরচ কম হওয়ায় কৃষকরা উৎসাহিত হয়ে এ ধান চাষে ঝুঁঁকে পড়েন।
এ ধান স্থানীয়ভাবে ‘হরি ধান’ নামে পরিচিতি পায়। ধানটি দেখতে মোটা, গাছ লম্বা ও শক্ত হওয়ায় পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়। চিটা কম হয়, আর বিচালির দামও বেশি। প্রতি বিঘায় অন্যান্য জাতের চেয়ে অন্তত ২৪ মণ বেশি ফলন হয়। চাষের খরচ প্রায় অর্ধেক। চাল রান্নার পর দেখতে ভালো লাগে এবং খেতেও সুস্বাদু।
এখন ঝিনাইদহের আসাদনগরসহ আশপাশের অন্তত ১০-১২টি গ্রামে এবং চুয়াডাঙ্গা জেলার কিছু অংশে এ ধান ব্যাপক হারে চাষ হচ্ছে। আজ হরিপদ কাপালি নেই। কিন্তু তাঁর হরিধান এখনো কৃষকের মাঠে সমৃদ্ধির জানান দিচ্ছে।
সোহেলের উদ্যোগটি হরিপদ কাপালির মতো না হলেও চেষ্টাটি একই। ধানের উচ্চমূল্য নিশ্চিত করার চেষ্টায় কামরুজ্জামান সোহেলের চোখে দেখতে পাই আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি। তাঁর মুখে হাসি, হাতে বাসমতী ধানের আঁটি, আর মনে দেশের কৃষিকে বদলে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণদের হাত ধরে যে নয়া কৃষির সূচনা হয়েছে, সেখানে উচ্চমূল্যের ফল-ফসল; হাঁস-মুরগি; গরু-বাছুর লালনপালন ও নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। অনেকেই ভিন দেশ থেকে স্ব-উদ্যোগে ব্যক্তি পর্যায়ে বীজ ও সায়ন এনে নতুন নতুন কৃষির উদ্যোগ নিচ্ছেন। এখানে প্রশ্ন থেকে যায়, ভিনদেশি নতুন ফল-ফসল আমাদের মাটি, আবহাওয়া ও পরিবেশের জন্য কতটা নিরাপদ! সেটি দেশের আবহমান কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কি না, তা নিয়েও বিস্তর গবেষণা এবং চাষের উপযোগিতা সম্পর্কে যাচাইবাছাই প্রয়োজন।
লেখক : মিডিয়াব্যক্তিত্ব