বাম তাত্ত্বিক হিসেবে আনু মুহাম্মদকে চেনেন না এমন লোক রাজনৈতিক মহলে নেই। তিনি পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখে থাকেন। তা ছাড়া তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা ২২টি। তিনি প্রথম জীবনে বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে ছিলেন এবং লেখক শিবিরের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক বড় কৃতিত্ব হলো- তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা নিয়ে আন্দোলন করা। অনেকে বলেন, এ আন্দোলন না থাকলে এ দেশের খনিজ সম্পদ বহু আগেই বিদেশি মাফিয়া শক্তি দখলে নিত। তাঁর কমিটির নেতৃত্বে ২০০৬ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এশিয়া অ্যানার্জির বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু হয়। ২৬ আগস্ট বিডিআরের গুলিতে তিন আন্দোলনকারী মারা যান এবং দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এ আন্দোলনের ইমেজে আন্দোলনের নেতা আমিনুল ইসলাম বাবলু উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং পেশাজীবী সংগঠনের আহ্বায়ক মুরতজা সরকার মানিক পরপর দুবার পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। আনু মুহাম্মদ দুজনের বিজয়কে বিরাট সাফল্য হিসেবে বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন। ভারত থেকে বিশিষ্ট সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী একবার বেড়াতে এলে বিজয়ের স্মারক হিসেবে দুজনের নাম উল্লেখ করেন। কিন্তু উপজেলা পরিষদ কী, তাদের কাজের পরিধি কী, পৌর মেয়রের কাজ কী ইত্যাদি সম্পর্কে কোনোদিন কোনো কথা বলেছেন বলে আমার জানা নেই। ঠিক এ জায়গা থেকে তাঁর চেতনার সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু। তিনি বিশ্ব, মহাবিশ্ব, কার্ল মার্কস, ডাস ক্যাপিটালসহ বহু কিছু জানেন; কিন্তু বাড়ির কাছে শিশির বিন্দু সম্পর্কে জানার ইচ্ছা পোষণ করেন না। চীনে এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থার মধ্যেও স্থানীয় ইউনিটগুলোকে ক্ষমতা দেওয়া আছে। পত্রিকায় উঠেছে- এক খনিজপ্রধান শহরে কেউই মেয়র হতে চান না। কারণ ওই শহরে খনিজ দুর্ঘটনা বেশি হয়। ফলে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। কিন্তু পৌরসভার ফান্ডে পর্যাপ্ত নিজস্ব অর্থ না থাকায় পৌর মেয়রকে বেকায়দায় পড়তে হয়। এটাই স্থানীয়দের সরকার ও এটাই বিকেন্দ্রীকরণ। কিন্তু বামপন্থিদের কর্মতৎপরতা দেখে মনে হয় তারা সবাই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে ভাবেন; কিন্তু তাদের সরকারব্যবস্থা নিয়ে ভাবেন না। এ প্রসঙ্গে একটি বাস্তব ঘটনার কথা বলি। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে নিয়ে তখন সভা-সেমিনার সরগরম। নিউইয়র্ক প্রবাসী আবু তালেব ‘গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা’ নিয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন। তাঁর রূপরেখাটি পছন্দ হওয়ায় ঢাবির সমাজবিজ্ঞানের প্রবীণ শিক্ষক মোহাব্বত খান, জাবির ড. আবুল কাশেম মজুমদার, ঢাবির নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসানসহ বেশকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ আন্দোলনে জড়িত হন। তাঁরা রূপরেখাটি আরও মডিফাইড করে ‘সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাটিক লোকাল গভর্ন্যান্স-সিডিএলজি নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। আমি যেহেতু স্থানীয় সরকারের মাঠপর্যায়ের কর্মচারী, সে কারণে আন্দোলনের ক্যাম্পেইনের দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্যাম্পেইনের সূত্র ধরে খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা এইচ এম এরশাদ, অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, সিরাজুল আলম খান, আকবর আলি খান, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রুহুল কবির রিজভী, জোনায়েদ সাকিসহ বহু রাজনীতিক ও গবেষকের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ হয়েছে। বলা যায়, কে কতটুকু গণতন্ত্র চান- তা নিয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এক দিন টিএসসিতে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ঈশা মোহাম্মদ, বিচারপতি হাবিবুর রহমান বসেছিলেন। সেখানে আমরা গেলে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী আনু মুহাম্মদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এরা চমৎকার কাজ করছে। প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরণের কাজ এরাই করছে। আপনারা ইচ্ছা করলে এদের কর্মসূচিকে কাজে লাগাতে পারেন।’ উল্লেখ্য, নাগরিকরা ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড যে কোনো একটিতে বসবাস করে। এ ইউনিটগুলোতে সামাজিক সুরক্ষা ও নাগরিক সেবামূলক বহু কাজ দেওয়া রয়েছে। যেমন- ভিজিডি, ভিজিএফ, টিআর, টিসিবি, নাগরিক সনদ, জন্ম নিবন্ধন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, শিক্ষা, হাটবাজারের টোল আদায়ে তদারকিসহ বহু কাজ। এগুলো নিয়ে আন্দোলন করলে দলীয় কর্মসূচি নিচ থেকে উপরমুখী হয়ে পড়বে এবং দলে নতুন নতুন নেতা-কর্মী তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আনু মুহাম্মদ সব শুনে খ্বু খুশি হলেন। তিনি এটা নিয়ে নিরিবিলি পরিবেশে বৈঠক করার জন্য তাঁর মালিবাগের বাসায় যাওয়ার জন্য একটি তারিখ দেন। কয়েকদিন পর তিনি টেলিফোনে জানান, অজ্ঞাত কারণে তিনি বৈঠকটি করতে পারছেন না। আমাদের নির্মম পরিহাস, আমরা ২০০৮ সালে শাসনগত ত্রুটি নিয়ে যা যা বলেছি, সেসব কথা জুলাই আন্দোলনের তরুণরা বলেছে এবং সংস্কার কমিশনের সদস্যরাও আমাদের কথা কিছুটা সংস্কার করে উপস্থাপন করেছেন (এ বিষয়ে আমাদের ৪টি লিখিত বই আছে)। আরও পরিহাসের বিষয়- আনু মুহাম্মদও ৫ আগস্টের আগে ‘বাংলাদেশের বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য পাঁচটি প্রস্তাব’ দিয়েছেন। যেটা তিনি ২০০৮ সাল থেকে শুরু করলে শাসনগত সংকটের একটি সমাধান বের হতো; এমনকি শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বও দিতে পারতেন। কাজেই পরিণত বয়সে আমার বিশ্বাস জন্মেছে- বামেরা গণতন্ত্রের কথা বলেন বটে; তবে এটা যে একটা দর্শন, আদর্শ, মতবাদ ও ডিজাইন হতে পারে, তা তারা নিজেরা বুঝতে অক্ষম হয়েছেন এবং বোঝাতেও ব্যর্থ হয়েছেন।
লেখক : গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারবিষয়ক গবেষক