মোটরগাড়ি রাস্তায় চালাতে নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক। অথচ দেশের বিভিন্ন সড়কে চলছে নিবন্ধনহীন আড়াই লাখ গাড়ি। ফলে ওই গাড়ির মালিকরা থাকছেন করের আওতার বাইরে। এতে প্রতিবছর সরকার হারাচ্ছে অন্তত ছয় হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
মোটরযানে কিউআর কোড সংবলিত ই-ট্যাক্স টোকেন সনদ বিষয়ে অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিবরণী সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সম্মেলনকক্ষে সম্প্রতি এই সভা হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত পরিবহন আছে ৬৪ লাখ ৪২ হাজার ৫৭৩টি। এর মধ্যে বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, ট্রাক, অ্যাম্বুলেন্স, মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, প্রাইভেট প্যাসেঞ্জার কার, পিকআপ, ট্যাক্সি ক্যাব, জিপ, ট্রাক্টর অন্যতম।
বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, এখনো আমাদের দেশে দুই থেকে আড়াই লাখ গাড়ির নিবন্ধন নেই। গাড়িগুলো নিবন্ধনের আওতায় আনা প্রয়োজন। ই-ট্যাক্স টোকেন আমাদের দেশে বাস্তবায়ন করা হলে ভালো হবে। তবে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) ট্যাগ ব্যবহারে গাড়ির যাবতীয় তথ্য চলে আসে। অর্থ বিভাগের উপসচিব মোস্তাক আহম্মেদ বলেন, শ্রীলঙ্কায়ও পরিবহন খাতে এই সিস্টেম চালু হয়েছে। যেকোনো গাড়ির বডি স্ক্যান করলে সব তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংযুক্ত ডেটা বেইসে চলে আসে।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) পাঁচ হাজার ৪৮৯টি বিলাসবহুল গাড়ির কর নথি যাচাই করেছে। এতে দেখা গেছে, এক হাজার ৩৩৯ জন বিলাসবহুল গাড়ির মালিক কর ফাঁকি দিতে তাঁদের গাড়ির তথ্য গোপন করেছেন। সিআইসি ধারণা করছে, এসব গাড়ির মালিক এক হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। এসব গাড়ির প্রতিটির বাজারদর (শুল্ক ও করসহ) এক কোটি থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে। তালিকায় রয়েছে টয়োটা, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিস, জিপ, ল্যান্ড রোভার, অডি, ল্যান্ড রোভার, পোরশে, জাগুয়ার, বেন্টলি, রোলস-রয়েস, ক্যাডিলাক, মেসারাতি, টেসলা, ফেরারি ও ল্যাম্বারগিনি।
আয়কর আইন-২০২৩ অনুযায়ী, সব সম্পদের তথ্য কর নথিতে উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। এসব তথ্য উল্লেখ না করলে আয়কর আইনে জরিমানা ছাড়াও ফৌজদারি মামলার বিধান রয়েছে। দেশের সড়কগুলোতে নানা ধরনের গাড়ি চলে। গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষমতা অনুসারে বা সিসিভেদে অগ্রিম কর নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৫০০ সিসির কম গাড়ির মালিককে প্রতিবছর ২৫ হাজার টাকা অগ্রিম কর দিতে হয়। ১৫০০ সিসির বেশি, কিন্তু ২০০০ সিসির কম বা ৭৫ থেকে ১০০ কিলোওয়াট, এমন প্রাইভেট কার ও জিপ গাড়িতে কর ৫০ হাজার টাকা, ২০০০ সিসি থেকে ২৫০০ সিসির কম বা ১০০ থেকে ১২৫ কিলোওয়াট গাড়িতে ৭৫ হাজার টাকা, ২৫০০ থেকে ৩০০০ সিসির কম বা ১২৫ থেকে ৩০০ কিলোওয়াটের গাড়িতে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা, ৩০০০ সিসি থেকে ৩৫০০ সিসি বা ১৫০ থেকে ১৭৫ কিলোওয়াটের গাড়ির জন্য দুই লাখ টাকা এবং ৩৫০০ সিসির বেশি বা ১৭৫ কিলোওয়াটের গাড়ির জন্য বার্ষিক অগ্রিম কর সাড়ে তিন লাখ টাকা।
জানা গেছে, বাংলাদেশে যত ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহৃত হয়, এর প্রায় ৮০ শতাংশই ১৫০০ সিসির কম। সে হিসাবে আড়াই লাখ গাড়ি নিবন্ধনের আওতায় থাকলে সেগুলো থেকে কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা করে অগ্রিম কর জমা হতো। এই হিসাবে সরকার অগ্রিম কর বাবদ পেত ছয় হাজার ২৫০ কোটি টাকা।
এই গাড়িগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা ও ই-ট্যাক্স টোকেন চালু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে সভায়। সেখানে এনবিআরের প্রতিনিধি জানান, এই পদ্ধতি চালু করলে কর আদায় বাড়বে। নিবন্ধনহীন গাড়ি নিবন্ধনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়া ই-ট্যাক্স টোকেন ব্যবহারে স্বচ্ছতা বাড়বে। নিয়মিত কর দিতে আগ্রহী হবে গ্রাহক। তিনি বলেন, মফস্বলে ট্যাক্স টোকেনের টাকা সরাসরি আইবাসে জমা হয় না। এতে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে।
বর্তমানে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ টোল পরিশোধে ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহার করছে। অত্যাধুনিক এ সিস্টেম দিয়ে করোনাভাইরাসের সনদের মতো ই-ট্যাক্স টোকেন তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা যায়। এতে মুদ্রণের খরচ কমবে। গ্রাহকের সময় বাঁচবে, দুর্নীতি ও জালিয়াতি রোধ হবে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে। এই পদ্ধতিতে গ্রাহক অনলাইনে টাকা পরিশোধ করে অনলাইনেই প্রত্যয়ন সংগ্রহ করতে পারেন। মোবাইল ব্যাংকিং, ই-ওয়ালেট ব্যবহার করে টোল পরিশোধ সম্ভব। অন্যদিকে আগের পদ্ধতিতে ব্যাংকে গিয়ে টাকা জমা দিতে হয়।
তবে কিউআর কোড নকল করা যায় বলে উল্লেখ করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিনিধি বলেন, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ই-সাইন জেনারেট করলে নকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। তবে কিউআর কোডে ই-সাইনের সংযুক্তি এবং যে প্রযুক্তির মাধ্যমে পুলিশ এটাকে ভেরিফাই করবে, তাদের সেই অ্যাপ ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘বিআরটিএর সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। তারা যদি গাড়ি নিবন্ধনের আওতায় আনতে না পারে তাহলে কর আদায়ের সুযোগ নেই। তাই প্রাথমিকভাবে তাদের নিবন্ধনে জোর দিতে হবে।’
সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ