টেকনাফের শামলাপুর সৈকতের সম্প্রতি দেখা গেছে ব্যতিক্রমী এক দৃশ্য। শতাধিক জলপাইরঙা কাছিমের বাচ্চা ফিরে যাচ্ছে তাদের আপন ঠিকানা সাগরের দিকে। চার মাসের টানা চেষ্টা আর নিবেদিত কর্মকাণ্ডের ফলাফল এখন দৃশ্যমান। ছোট্ট এক উদ্যোগের হাত ধরে সমুদ্রে ফিরেছে ১০ হাজার ৫৩টি কাছিমের বাচ্চা, যা দেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এক অনন্য মাইলফলক।
প্রাকৃতিক পরিবেশে কাছিমের বংশবৃদ্ধি এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিবছর শীতকালে দেশের দীর্ঘ উপকূলজুড়ে শত শত মা কাছিম আসে ডিম পাড়তে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনচাপ, হোটেল-রিসোর্টের কৃত্রিম আলো, মাছ ধরার জাল আর বেওয়ারিশ কুকুরের উৎপাতে এখন উপকূলীয় এলাকাগুলো মা কাছিমের ডিম পাড়ার জন্য নিরাপদ নয়।
এই বাস্তবতায় টেকনাফের শামলাপুরে গড়ে তোলা হয়েছে একটি আলাদা উদ্যোগ। বেসরকারি সংস্থা ‘কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ (কোডেক) প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চালু করেছে ৫টি হ্যাচারি। আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘আইইউসিএন’ ও ‘জিআইজেড’-এর সহায়তায় বাস্তবায়িত এই প্রকল্পে গত শীত মৌসুমে ১২৯টি মা কাছিমের বাসা থেকে সংরক্ষণ করা হয় ১৪ হাজার ৭২২টি ডিম।
ডিমগুলোকে প্রাকৃতিকভাবেই বালুর নিচে পুঁতে রাখা হয় হ্যাচারিগুলোতে। প্রতিটি বাসার ডিম আলাদাভাবে রাখা হয় যাতে সুরক্ষা ও পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করা যায়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডিম ফুটে বের হয়েছে ১০ হাজার ৫৩টি কাছিমের বাচ্চা। প্রায় ৬৭ দশমিক ২৮ শতাংশ ডিম থেকেই সফলভাবে বাচ্চা ফুটেছে। এই বাচ্চাগুলোকেই সম্প্রতি ধাপে ধাপে সাগরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, কাছিমের জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় ডিম ফুটে সাগরে ফিরে যাওয়ার প্রথম সপ্তাহ। এ সময় তারা খুব কম খায়, সাঁতার কাটা শেখে এবং গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যেতে চায়, যেখানে তাদের খাবারের প্রাকৃতিক উৎস রয়েছে। তবে এই পথে প্রাণ হারায় প্রায় ৯৮.৫ শতাংশ কাছিমের বাচ্চা। বেঁচে থাকা অল্প সংখ্যক কাছিমই ভবিষ্যতে পূর্ণবয়স্ক হয়ে আবার ফিরে আসে তাদের জন্মস্থানেই—ডিম পাড়ার জন্য।
এই পুরো প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল কাছিমের গমনপথ অনুসন্ধান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শামলাপুর সৈকত থেকে চারটি মা কাছিমের পিঠে বসানো হয় স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং যন্ত্র। এর মাধ্যমে ধরা পড়ে আশ্চর্যজনক ভ্রমণের চিত্র—একটি কাছিম ১৪৪ দিনে পাড়ি দিয়েছে প্রায় ৩,৫০০ কিলোমিটার পথ, পৌঁছে গেছে শ্রীলঙ্কার মুল্লাইথিভু উপকূলে। বাকি তিনটি কাছিমও হাজার কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করেছে, যার অধিকাংশই ভারত মহাসাগরে।
এই তথ্যগুলো কেবল বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং স্পষ্ট করে যে সমুদ্রজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই প্রাণীটির জীবন কতটা জটিল আর বিপন্ন। জলপাইরঙা কাছিম আজ বিশ্বব্যাপী সংকটাপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত।
বাংলাদেশে পাওয়া যায় সামুদ্রিক কাছিমের অন্তত পাঁচটি প্রজাতির অস্তিত্ব, যার মধ্যে জলপাইরঙা কাছিমের ডিম পাড়ার হার সবচেয়ে বেশি। মাঝে মধ্যে দেখা মেলে সবুজ কাছিমেরও। তবে বাকি প্রজাতিগুলো একেবারেই বিরল।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কাছিম সংরক্ষণে প্রয়োজন বড় কোনো অবকাঠামো নয় বরং কয়েক কিলোমিটার নিরাপদ বালুময় সৈকত। যদি শীত মৌসুমে কক্সবাজার-টেকনাফ উপকূলের অন্তত কিছু অংশকে করা যায় জালমুক্ত ও আলোকদূষণহীন, তাহলেই মা কাছিমেরা নিরাপদে ডিম পাড়তে পারবে।
সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এখন প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন। প্রকৃতি তার কাজ করে যাচ্ছে, শুধু দরকার মানবিক সহানুভূতি ও উদ্যোগ।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল