আত্মশুদ্ধির মাস রমজান। এ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্র, এমনকি অনেক অমুসলিম অধ্যুষিত দেশেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো হয়। মূল্যছাড়ের রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। দাম কমানো যেন তাদের রীতিতে পরিণত হয়েছে। রমজান উপলক্ষে আরব ভূখন্ডসহ দেশবিদেশে পণ্যে মূল্যছাড় কেমন, তা নিয়ে আজকের রকমারি-
আমিরাতে এক মাস আগে থেকেই মূল্যছাড়
রমজান শুরু হওয়ার এক মাস আগে থেকেই মূল্যছাড় দেওয়া হয় আরব আমিরাতে। রমজানের ১০ দিন আগে সেটি বেড়ে যায় অনেকাংশে। প্রায় ৬ হাজার পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়। অনলাইনে পণ্য কিনলেও দামে ছাড় পাওয়া যায়। লাভ কম হলেও বিক্রি বাড়ে। বিক্রেতারাও মানসিক প্রশান্তি পান। বাজারে নিত্যপণ্যে মূল্যছাড়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভোক্তা সুরক্ষা বিভাগ কিছু কিছু পণ্যে ৫০ শতাংশের ওপর ছাড় ঘোষণা করে। পুরো রমজানে বিভিন্ন পণ্যের ওপর এ মূল্যছাড় বলবৎ থাকে। রমজানে মানুষকে স্বস্তি দিতে এ উদ্যোগ নিয়ে থাকে তারা। দ্য শারজাহ কো-অপারেটিভ সোসাইটি বলছে, দাম কমানো এসব পণ্যের ৮০ শতাংশই নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য। রান্নার তেল, আটা ও চালের মতো পণ্যের দাম ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়। এ ছাড়া সাপ্তাহিক মূল্যছাড়ও দেওয়া হয়। কেনাকাটায় ৩০০ দিরহাম বা এর বেশি অর্থ খরচ করা ক্রেতাদের জন্য থাকে বিশেষ পুরস্কার। দান করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য ৯৯ থেকে ৩৯৯ দিরহাম পর্যন্ত তিন ধরনের খাবারের ঝুড়ি থাকে।
শারজাহ চ্যারিটির সহায়তায় এসব খাবার বিতরণ করা হয়। শারজাহ কো-অপারেটিভ সোসাইটির প্রধান নির্বাহী মজিদ আল-জুনাইদ বলেন, ‘বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল নিয়ে চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও শারজাহ কো-অপারেটিভ সোসাইটি সব শাখায় প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। রমজানে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও সাশ্রয়ী মূলে পণ্য সরবরাহের নিশ্চয়তা দিচ্ছি আমরা।’ দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন কো-আপ ৪ হাজার পণ্যে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দেয়। খুচরা ব্যবসায়ীরা রমজান মাস উপলক্ষে ভোক্তাদের নানা রকম সুবিধা দিয়ে থাকে। এসবের মধ্যে রয়েছে পণ্যের মূল্য স্থির রাখা, এখন কিনে পরে দাম দেওয়ার সুযোগ, ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে অতিরিক্ত মূল্যছাড় এবং ৫ হাজার দিরহামের গিফট কার্ড। সবার ওপরে থাকে ‘গত বছরের চেয়েও কম দাম’ প্রতিশ্রুতি। দেশটিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা বিশাল সব হাইপার মার্কেট চালায়। এসব বিপণিবিতানে পাওয়া যায় না, এমন জিনিস বিরল। অনেক পণ্যে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়। খালিজ টাইমস জানিয়েছে, রমজান উপলক্ষে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন ও নুন যেমন নানা রকম সুবিধা দেয়, তেমনি হাইপার মার্কেটগুলোও অনলাইন এবং দোকানে এসে পণ্য কেনার ক্ষেত্রে সুবিধা দেয়। মাজিদ আল-ফুতাইমের মালিকানাধীন ক্যারেফোর শুরু করে ‘গত বছরের চেয়েও কম মূল্য’ প্রচারণা। ক্যারেফোর ৫ হাজার পণ্যে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড় দেয়। যার মধ্যে নিত্যপণ্য, তাজা খাদ্য, রান্নার সরঞ্জাম, ইলেকট্রনিকসহ অনেক কিছু থাকে। এর বাইরে চাল, দুধ, তেলের মতো ১০০টি পণ্যের দাম স্থির রাখার ঘোষণা দেয় বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি। ক্যারেফোর ৫ কোটি দিরহাম বরাদ্দ করে। যাতে আরও ১০০টি পণ্য গত বছরের চেয়ে কম দামে বিক্রি করা যায়। তেল আর দুধের দাম সবচেয়ে কম থাকে। মাজিদ আল-ফুতাইমের কান্ট্রি ম্যানেজার বারট্র্যান্ড লুমে বলেন, ‘এ মাসে অগ্রাধিকার হলো, আমাদের গ্রাহকরা যাতে স্বাস্থ্যসম্মত, পুষ্টিকর ও ভালোমানের খাবার সামর্থ্যরে মধ্যে কিনতে পারেন। রমজানে আমাদের কর্মীরা গতবারের চেয়ে পণ্যের দাম কম রাখছেন। রমজানের সত্যিকার মর্মবাণীর সঙ্গে সংগতি রেখে আমরা নানা রকম দাতব্য কর্মকান্ডের পরিকল্পনা করছি।’ আরব আমিরাতে আরেক পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সাফির। তাদের একজন পরিচালক বেজয় টমাস বলেন, তারা ৬০০ পণ্যের ওপর বিশেষ মূল্যসুবিধা দিচ্ছেন। অনেক পণ্যে ৫০ শতাংশের বেশি মূল্যছাড় দেওয়া হচ্ছে। উদ্দেশ্য ‘সব পরিবারের চাহিদা মেটানো’। লুলু গ্রুপ হাইপার মার্কেট পরিচালনা করে। তারা পোলট্রি পণ্য, তাজা ও হিমায়িত খাদ্য, রান্নার তেল, ডাল, মসলা, দুগ্ধজাত পণ্য ও রান্নাঘরের বিভিন্ন সরঞ্জামের ওপর ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দেয়।
বেসরকারি খুচরা বিক্রেতাদের বাইরে সরকার-সমর্থিত সমবায় প্রতিষ্ঠানগুলোও মূল্যছাড়ের এ প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। হাজার হাজার পণ্যের দাম তারা ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমায়। অ্যামাজন ইউএই ও সৌদি আরব শাখার ভাইস প্রেসিডেন্ট স্তেফানো মার্তিনেলি বলেন, ‘এ অঞ্চলে রমজান মাস বছরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সময়। গ্রাহকদের সময় ও অর্থ সাশ্রয় করতে সহায়তার মাধ্যমে আমরা দায়িত্ব পালন করছি। আমাদের গ্রাহকরা যখন ইবাদত করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন আমরা তাদের জীবন একটু সহজ করছি। যাতে তারা পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে আরেকটু বেশি সময় কাটাতে পারেন।’
আল-মায়া গ্রুপের পরিচালক কামাল ভাচানি বলেন, ‘তিনটি ভাগে আমরা সুবিধা দিয়ে থাকি। রমজানের আগে আহলান রমাদান, রমাদান কারিম ওয়ান এবং রমাদান কারিম টু। ৫ শতাধিক পণ্যে সব ধরনের ক্রেতাদের জন্য আমরা সুবিধা দিয়ে থাকি। বিপুল মূল্যছাড়ের পাশাপাশি থাকে সাশ্রয়ী মূল্য। রমজানের আগেই সব সুবিধা চালু হয়। সব মিলিয়ে ৪৫ দিন ধরে চলে এ বিশেষ সুবিধা।’
সৌদি আরবে পণ্যের দাম বাড়ালে জরিমানা
রমজান ঘিরে সৌদি আরবে বাড়ে না নিত্যপণ্যের দাম। পবিত্র এ মাসে মানুষকে সেবা দিতে ব্যাপক মূল্যছাড় দেন ব্যবসায়ীরা। এ সুযোগে সুপারমার্কেট থেকে শুরু করে কাঁচা বাজারে থাকে ক্রেতাদের বেশ ভিড়। সৌদি নাগরিক ও অভিবাসীদের রমজানের পবিত্রতা রক্ষার আহ্বান জানান দেশটির বাদশাহ। পাশাপাশি রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যেন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে বলেন। কারণ ছাড়া পণ্যের দাম বাড়ালে আছে জরিমানার ব্যবস্থা। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বক্তব্য, রমজানে তারা দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করেন। রমজান হিসেবে দাম বাড়ে না সেখানে। বিভিন্ন মার্কেটে ছাড় দিয়ে থাকে। সৌদি আরবে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম ক্রেতা সাধারণের ক্রয়ের মধ্যে রাখতে প্রতিযোগিতায় নামেন ব্যবসায়ীরা। বিশাল মূল্যছাড় দিয়ে বিক্রি করা হয় সব ধরনের পণ্য। সুপারমার্কেটগুলোয় প্রতিটি পণ্যে দুই থেকে তিন রিয়াল করে মূল্যছাড় দেওয়া হয়। কাঁচাবাজারেও সরকারি নিয়ম মেনে বিক্রি করা হয় সব ধরনের শাকসবজি ও মাছ-মাংস। চাল, ডাল, তেল, লবণসহ সবকিছুর দামই থাকে ক্রেতাদের নাগালে। আম, আনারস, আপেল, কমলা, মাল্টা, তরমুজ, কলাসহ বিভিন্ন ফলের দাম রোজায় বেশ কমে। কঠোরভাবে সরকার বাজার মনিটরিং করে। সরকারের এমন পদক্ষেপে জনগণ খুশি। বিভিন্ন পণ্য সরবরাহ কোম্পানি রমজানে ১২ হাজার পণ্যে মূল্যছাড়ের ঘোষণা দেয়। খাদ্যপণ্যে সর্বোচ্চ ৭৭ শতাংশ এবং খাদ্যপণ্য না হলে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড় দেন তারা।
কুয়েতে দোকানে দোকানে মূল্যছাড়ের হিড়িক
রমজান এলেই কুয়েতের বিভিন্ন এলাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় সুপার মার্কেট, লুলু হাইপার, সিটি সেন্টার, সুলতান সেন্টার, ক্যারিয়ার, গ্রাউন্ড হাইপার অনকোস্টসহ মোটামুটি সব দোকানই মূল্যছাড়ে মেতে ওঠে। কে কত ছাড় দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারে, তা নিয়ে বিভিন্ন মার্কেটে রীতিমতো চলে প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই সেখানকার বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরাও। বিশেষ মূল্যছাড়ের লিফলেট বিতরণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা, পণ্যের সঙ্গে ফ্রি দেওয়া থেকে শুরু করে কিছু কিছু পণ্যে ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়ে বিক্রি করতে দেখা যায় বড় বড় সুপারমার্কেট ও বাংলাদেশিদের শপগুলোতে। রোজা সামনে রেখে বেচাকেনা বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও খুশি থাকেন। সুপারশপ ও দোকান ঘুরে দেখা যায়, চাল, ডাল, তেল, চিনি ও ফলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব পণ্যের চাহিদা রমজান মাসে বেশি থাকে, সেগুলোতে থাকে বিশেষ ছাড়। বিভিন্ন মার্কেটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরাও বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকেন। এসব দোকান থেকে বিভিন্ন দেশের পণ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশি পণ্যও কিনে থাকেন বিদেশি ক্রেতারা। রমজানে কেউ যাতে কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে না পারেন, সেজন্য পণ্যের দাম ও মেয়াদ থাকা বাধ্যতামূলক করে থাকে কুয়েতি কর্তৃপক্ষ। তা খতিয়ে দেখতেও ভোক্তা অধিকার ও সরকারের একাধিক সংস্থার লোক নিয়মিত বাজার মনিটরিং করে। অতিরিক্ত মূল্য কিংবা মানহীন পণ্য বিক্রি হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। অসংগতি ধরা পড়লে আইন অমান্যকারীকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করে কর্তৃপক্ষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন অমান্য করলে প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেওয়া হয়। রমজান উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে নানা উদ্যোগ নেন। এতে রোজাদারের অতিরিক্ত অর্থকষ্ট লাঘবে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেন দেশটির ব্যবসায়ীরা। এখানে ভোক্তা অধিকার নিয়মিত পরিদর্শনে আসে। চাইলেও কারও মূল্য বাড়ানোর বা ভেজাল মাল বিক্রির সুযোগ নেই। রমজান মাসে কম দামে বিক্রি করে। বেচাকেনা বেশি হয়। কুয়েতের বাজারে পণ্যের দামে কোনো অসংগতি খুঁজে পায় না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কুয়েত বাজার মনিটরিং সংস্থা বলদিয়া অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজানে পণ্যের মান ও দাম নজরদারি করে অনিয়ম পেলে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়। পাশাপাশি কুয়েত সরকার কিছু কিছু পণ্যের ওপর ভর্তুকি দিয়ে থাকে; যা সরকার নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি করতে হয়।
কাতারে দাম কমে ৮০০ পণ্যের
কাতারে রমজানে রোজাদারদের সেবায় ৮০০টিরও বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো হয়। রমজানের শুরু থেকেই এ মূল্যছাড় কার্যকর হয়। রমজান মাস শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের সবাই এ সুবিধা ভোগ করেন। কাতারের সব বাজার ও সুপারশপে সরকারের এ আদেশ কার্যকর থাকে। রমজানের পাঁচ দিন আগে থেকেই হ্রাসকৃত মূল্যে এসব ভোগ্যপণ্য কিনতে পারেন ভোক্তারা। কাতারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রমজানের শুরু থেকে কার্যকর হওয়া নতুন মূল্যতালিকা এ মাসের শেষ পর্যন্ত চলবে। দুধ, দই, দুগ্ধজাত পণ্য, টিস্যু পেপার, পরিচ্ছন্নতা সরঞ্জাম, রান্নার তেল, ঘি, পনির, হিমায়িত সবজি, বাদাম, পানি, ফলের রস, মধু, ব্রয়লার মুরগি, রুটি, টিনজাত খাবার, পাস্তা, সেমাই, গোলাপ জলসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম কমানো হয়। কাতারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, অর্থনৈতিক কারণে খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেগুলো কম দামে ভোক্তাদের সরবরাহ করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়া কাতারে রোজার অন্যতম অনুষঙ্গ প্রায় ২৫ ধরনের খেজুরের ওপর থাকে বিশেষ মূল্যছাড়। সরকার নির্দেশিত মূল্যে ক্রেতাদের কাছে পণ্য বিক্রির নির্দেশ রয়েছে কাতার সরকারের।
মিসরে বিশেষ ছাড়ে খাদ্যমেলার আয়োজন
রমজান উপলক্ষে মিসরের রাজধানী কায়রোতে দেশটির চেম্বার অব কমার্স ফেডারেশনের সহযোগিতায় সরকারের তত্ত্বাবধানে সপ্তাহব্যাপী খাদ্যমেলার আয়োজন করা হয়। রমজান মাস সামনে রেখে ছাড়সহ খাদ্যসামগ্রী কেনার ব্যবস্থা করতে এ মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। আরবি ভাষায় ‘রমাদান কারিম’ লেখা ব্যানার ও মিসরের ঐতিহ্যবাহী রমজান লণ্ঠন দিয়ে মেলাপ্রাঙ্গণ সাজানো হয়। এ মেলায় কয়েক শ প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে অংশ নেয়। এসব প্রতিষ্ঠান প্রধানত রান্নার তেল, চাল, পাস্তা, মাংস, মুরগির মাংস, শাকসবজি, ফল, বাদাম এবং অন্যান্য পণ্য বিক্রি করে। মেলায় মিসরের সুপরিচিত খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যে মূল্যছাড়ের বৈচিত্র্যময় অফার দিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ করে। মিসরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে গমের দাম বেড়ে গেছে। সংগত কারণেই গমজাত খাবারের মূল্যবৃদ্ধির এ সময়ে সহমর্মিতার মাস রমজানকে সামনে রেখে মানুষকে কিছুটা আনন্দ ও স্বস্তি দিতে এ আয়োজন। ‘ওয়েলকাম রমজান ফেয়ার’ নামে পরিচিত এ মেলা কয়েক বছর ধরে কায়রোতে অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় বিভিন্ন দোকান ঘুরে ঘুরে দাম পর্যালোচনা করে থাকে দেশটির সরকার। কায়রোর এ মেলা শেষ হলেও রমজান মাস এবং রমজানের পরে একই মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রির জন্য দেশব্যাপী প্রায় ৮ হাজার বিশেষ বুথ থাকে। এ ছাড়া মিসরীয় সেনাবাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে মূল্যবৃদ্ধির বোঝা কমাতে সাধারণ মানুষের সাহায্যের জন্য ভ্রাম্যমাণ দোকান থাকে।
ইউরোপ-আমেরিকায়ও কমে দাম
বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে ইউরোপজুড়ে রীতিমতো মূল্যছাড়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় উৎসবের ঠিক এক মাস আগে বাজারে উৎসবের আমেজ ভরপুর থাকে। সারা বছর যেন তারা এ দিনের অপেক্ষায় থাকে। স্বল্পমূল্যে পণ্য কিনতে পেয়ে যারপরনা খুশি হয়। সম্পদশালীরা এ সুযোগে সারা বছরের পণ্য কিনে রাখেন। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো অন্য ধর্মের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। তাই রমজান উপলক্ষেও তারা পণ্য কম দামে বিক্রি করে। এসব দেশের মুসলিম ব্যবসায়ী ও কোম্পানির মালিকরা রমজান উপলক্ষে পণ্যে ব্যাপক মূল্যছাড় দেন। বিশেষ করে থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড, ফিনল্যান্ড ও জার্মানির মুসলিম ব্যবসায়ীরা পণ্য কম দামে বিক্রি করেন। এমনও দেখা যায়, লাভ ছাড়াই ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রি করছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো ধর্মীয় উৎসবের সময় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ে না। রমজানও এর ব্যতিক্রম নয়। রমজানের শুরুতে পণ্যে ছাড় দেওয়া ইউরোপের দেশগুলোতে রীতিতে পরিণত হয়েছে। মুসলমানসহ সবার জন্য পণ্যে বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা দেয়। ব্যবসায়ীরা তাদের আগের মুনাফা থেকে ছাড় দিয়ে ব্যবসা করেন। পণ্যের দাম না বাড়িয়ে কমিয়ে দেন। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও কানাডার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় রমজানে নিত্যপণ্যের ওপর বিশেষ মূল্যছাড় দেওয়া হয়। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা জানান, এখানকার খুচরা দোকানে সারা বছরই বিভিন্ন পণ্যে ছাড় থাকে। তবে রোজা কিংবা মুসলমানদের অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবে তুরস্ক ও মরক্কোর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো মাংস, সবজি, ফলমূলসহ রোজায় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যে ২৫-৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়ে থাকে। মূলত ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সহনশীলতা বাড়াতে তারা এমন উদ্যোগ নেন।
মালয়েশিয়ায় মাসব্যাপী মূল্যছাড়
রোজার মাস উপলক্ষে মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ পণ্যে মূল্যছাড় দেওয়ার ঘোষণা থাকে। দেশটি চাল, ডাল, তেল, আদা, মসলা, সবজি, মাছ, মাংস, মিষ্টি, দই, খেজুর, পনিরসহ বিভিন্ন পণ্যের দামে ছাড় দিয়ে থাকে। পোশাক, প্রসাধনী, কাঁচামাল, অভোগ্য অন্যান্য পণ্যেও ব্যাপকভাবে মূল্যছাড় দেয় কর্তৃপক্ষ। বাজার স্থিতিশীল রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়। খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করতেও সরকার যথাযথ ভূমিকা রাখে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় মনিটরিং অব্যাহত রাখে স্থানীয় প্রশাসন। অন্য যে কোনো মাসের তুলনায় রমজান এলেই সিটি করপোরেশন তাদের তৎপরতা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। দেশটির জায়ান্ট, লুলু, মাইডিন, এনেসকে, এয়নবিগসহ বড় বড় সুপারশপে নিয়মিত অনলাইন ও অফলাইনে চলে বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। জনপ্রিয় অনলাইন শপ লাজাডা ও শপিং সাইটগুলো রমজান উপলক্ষে বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা দেয়।
দেশটির সব ছোটবড় দোকানে চলে বিশেষ মূল্যছাড়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসসহ সব পণ্যের দাম কমানো হয় অন্যান্য সময়ের চেয়ে। আগের চেয়ে কত টাকা কমানো হয়েছে, ক্রেতাদের দেখানো হয় সেই মূল্যতালিকা। ভোগ্যপণ্য নির্ধারিত মূল্যে বিক্রির নির্দেশনা জারি করে সরকার।
ওমানে কঠোর বাজার নজরদারি
ওমানবাসীর কাছে রমজান মানেই ভিন্ন রকম আয়োজন-উৎসব। ওমানবাসী রমজান মাসের অপেক্ষায় থাকে। কারণ রমজান আসার কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই দেশটির শপিং মলগুলো পণ্যের ওপর মূল্যছাড় দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। প্রতি বছর রমজান এলেই ওমান সরকার এ উদ্যোগ নেয়। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলোও পণ্যমূল্যে ছাড় দেয়। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরাও এ বছর পণ্যমূল্য ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ হারে ছাড় দিয়েছেন। কোনো ব্যবসায়ী যাতে এ আদেশ অমান্য করতে না পারেন, সেজন্য সরকার বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করে। এ ছাড়া খাদ্যসামগ্রীর গুণগতমান ও স্টোরেজ সুবিধা নিশ্চিত করতে বাজার পরিদর্শন এবং নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রমজানে ওমানের অভিজাত শপিং সেন্টারগুলো বিশেষ অফার দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমানো হয়।