রাজধানীর রামপুরা থেকে মোহাম্মদপুর যেতে অ্যাপে বাইক ডেকেছিলেন সোহান আহমেদ। ফোন রিসিভ করেই ‘রাইড ক্যানসেল করে দিন, এই ভাড়াতেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি, আপনি থাকুন’ বলছিলেন বাইক রাইডার। ব্যবসায়ী সোহান জানালেন এর আগে আরেক চালক ফোন ধরে গন্তব্যে যেতে রাজি হননি। তিনি অভিযোগ করেন, ‘অ্যাপে এখন মোটরসাইকেল পাওয়া যায় না। মোড়ে মোড়ে দাঁড়ানো থাকে, সেখানে দরদাম করে যেতে হয়।’
মিটারের সিএনজিতে যে যাত্রী হয়রানি সেই একই চিত্র এখন বাইক ভাড়ায়। অ্যাপে যাত্রীর পছন্দের জায়গায় যাওয়ার চেয়ে চালকরা এখন ‘খ্যাপে’ যাওয়ায় আগ্রহী। ‘পোষায় না’ অজুহাতে চালকরা শুরু করেছেন জোচ্চুরি।
সরেজমিন রাজধানীর মগবাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, পল্টন, সেগুনবাগিচা, মতিঝিল, ফকিরাপুল, আরামবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, রামপুরা, মৌচাক, বাড্ডা, নতুনবাজার, মিরপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অ্যাপ ছাড়াই রাইড শেয়ার বেড়েছে। সড়কে হাঁকডাক করে যাত্রী তুলছেন চালকরা। তাতে অনেক যাত্রী চালক খুঁজতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন, বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন সাধারণ বাইকারও। অতিরিক্ত ভাড়া, ডিজিটাল পেমেন্টে অনীহা, যাত্রী হয়রানি ও রাইড ক্যানসেল এসব সমস্যা নিয়ে চালক, যাত্রী ও রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পরকে দোষারোপ করছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, এখন বেশির ভাগ সময় অ্যাপে গন্তব্য জানালেই রাইডাররা না বলে দেন, কিংবা কলে ক্যানসেল করতে বাধ্য করেন। বাধ্য হয়ে অনেক যাত্রীই ‘খ্যাপে’ রাইড নিতে বাধ্য হচ্ছেন, যা নিরাপত্তাহীনতা বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে চালকদের দাবি, অ্যাপে কমিশন বেশি, জ্বালানি খরচ বেড়েছে, অথচ আয় তেমন বাড়েনি। ফলে বেআইনি হলেও ‘খ্যাপে’ রাইড দিয়ে তুলনামূলক বেশি আয় করা সম্ভব।
জানা গেছে, মোবাইল ফোন অ্যাপসভিত্তিক গাড়ি শেয়ার নেটওয়ার্ক ‘উবার’ ও ‘পাঠাও’র কার্যক্রম দেশে শুরু হয় ২০১৬ সালে। এরপর ধীরে ধীরে ১৪টি কোম্পানি রাইড সেবা চালু করে। এরপর থেকে সড়কে যানজট এড়িয়ে দ্রুত ও সহজে গন্তব্যে পৌঁছাতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এ রাইড শেয়ারিং। তবে, বাড়তি ভাড়া, অ্যাপসের প্রতি অনীহা ও যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ নানা রকম হয়রানির অভিযোগও রয়েছে চালকদের বিরুদ্ধে। অ্যাপসে না গেলে চালক ও গ্রাহক উভয়ের তথ্য অ্যাপস কোম্পানিগুলোর ট্র্যাকে থাকে না। চুক্তিতে বা খ্যাপে গেলে বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি।
১০ অক্টোবর সন্ধ্যায় ভাটারা এলাকা থেকে মগবাজার যাবেন বেসরকারি চাকরিজীবী মো. ইমরান চৌধুরী। উবারের অ্যাপে বাইক কল করেন। চালক রিসিভ করেই অ্যাপের ভাড়ায় নয়, দরদাম করে যেতে হবে। সেই সঙ্গে অ্যাপের কল ক্যানসেল করতে হবে বলে শর্ত দেন। রাইড রিসিভ করে কেন খ্যাপে যেতে চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গাড়ি নিজের, তেল নিজের, রক্ষণাবেক্ষণ নিজের তাহলে অ্যাপকে কমিশন দেব কেন?’ তিনি আরও জানালেন, এখন রাজধানীতে বাইকারের সংখ্যা দ্বিগুণ। এ জন্য যাত্রী পাওয়া যায় না।
আবদুর রশিদ নামে এক যুবক রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন বাইক চালাতে। কিছুদিন তিনি অ্যাপেই বাইক শেয়ার করতেন। কিন্তু দিন শেষে বাড়তি কমিশন দিতে হয় বলে এখন ‘খ্যাপে’ বাইক চালান। এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দৈনিক ১ হাজার টাকা আয় করতে তেল ফুরায় ৩০০ টাকার। অ্যাপে যাত্রীসেবা দিতে গেলে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কমিশনে ২৫০ টাকা দিতে হয় রাইড শেয়ারিং কোম্পানিকে। আনুষঙ্গিক আরও ১০০ টাকা খরচ হলে দিন শেষে ৩৫০ টাকা থাকে। আর অ্যাপভেদে ২৫ শতাংশের জায়গায় ১০ শতাংশ কমিশন দিলে দৈনিক আয় দাঁড়ায় ৫০০ টাকা। মগবাজার থেকে আদাবরে রাইড সেবা নেওয়া তুহিন হাওলাদার বলছেন, জ্যামের ঢাকায় বাইকে যাওয়া একটা স্বস্তিদায়ক বাহন ছিল। কিন্তু সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। অ্যাপে গেলে দেখা যায় রাইডারের আচরণ ভদ্র। আর খ্যাপে উঠলে তারা মানুষই মনে করে না। কারণ খ্যাপে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পরিবহন খাত সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। নাগরিককে সেবা প্রদানের জন্য সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোকে যথাযথ জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না।
যে কারণে সংকট বেড়েই চলেছে।’ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) সুফিয়ান আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেপরোয়া মোটরসাইকেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা সবসময় কঠোর অবস্থানে থাকি। প্রতিদিন ঢাকায় গড়ে ৫ শতাধিক মামলা ও ১৫-২০টি মোটরসাইকেল ডাম্পিং করা হচ্ছে। এরপরও মোটরসাইকেলের সংখ্যা এত বেশি যে, এটি নিয়ন্ত্রণে আমাদের হিমশিম খেতে হয়।’