সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার আমার একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার শিক্ষক-ছাত্রের মতোই সম্পর্ক ছিল। আমি যখন আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন থেকেই আলাপ। তখন তিনি দুর্দান্ত মেধাবী একজন শিক্ষক। তাঁর ক্লাস শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করত। যে কোনো বিভাগের শিক্ষার্থীর জন্য তাঁর দরজা ছিল খোলা। তারুণ্যকে অসম্ভব উদ্দীপ্ত করতেন। তারুণ্য মানেই নতুন কিছু, নতুন সৃষ্টি। তাঁর দর্শন ছিল, চিন্তা-চেতনা-মননে একজন মানবসন্তানকে সত্যিকার মানুষে পরিণত হতে হবে। মানুষ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। পৃথিবীর যে ভূখণ্ডের মানবসম্পদ যত বেশি মূল্যবান, সে ভূখণ্ড তত বেশি উন্নত। তাঁর স্বপ্ন ও চেষ্টা ছিল মূল্যবান মানবসম্পদ গড়ে তোলা, মানবসন্তানকে মানুষ হিসেবে তৈরি করা। জুলাই বিপ্লবের শুরুতে তিনি অনেক বেশি আশাবাদী হয়েছিলেন নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে। কিন্তু বিপ্লবোত্তর তাঁর মধ্যে ধীরে ধীরে হতাশা বাসা বাঁধে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির কোনো একদিন তিনি আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে তাঁর রুমে ডেকেছিলেন। সকাল ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত আমাকে সময় দিয়েছিলেন। একপর্যায়ে আমি জানতে চেয়েছিলাম বিপ্লবকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? আমার প্রশ্ন শুনে স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি তো জানো, আমি আমার ক্লাসে কোনো অমনোযোগী স্টুডেন্ট অ্যালাউ করি না। সেটা অনার্স ক্লাসেই হোক আর মাস্টার্স ক্লাসে। আমার শিক্ষার্থীরাও সেটা জানে। এমনও ঘটনা আছে, ক্লাসে বসে কথা বলেছে, সেজন্য ওই শিক্ষার্থীকে আমি ক্লাসে অ্যালাউ করিনি। আর এখন ক্লাসে আমি কোনো শিক্ষার্থীকে কিছু বলার সাহস পাই না।’ জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এখন তো সবাই নেতা। কেউ তো কাউকে মানছে না। কোনো শিক্ষার্থী যদি বেয়াদবি করে, তাহলে তো আমি মর্মবেদনায় নিঃশেষ হয়ে যাব। সে কারণেই কিছু বলছি না।’ বিপ্লবের ভবিষ্যৎ কী-জানতে চাইলে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘বিপ্লব শেষে সবাই যার যার স্থানে ফিরে না গেলে, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে না ফিরলে বিপ্লব মুখ থুবড়ে পড়বে। কয়েকটা জেনারেশন নষ্ট হয়ে যাবে। সমাজে, রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা থাকবে না। মানুষের মধ্যে উগ্রতা প্রকাশ পাবে। আমার ধারণা আমরা সেদিকেই যাচ্ছি। যদি তাই হয় তাহলে এমন কষ্ট মেনে নেওয়া কঠিন হবে। সেই কষ্টের আশঙ্কাই আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না।’ স্যারের সেই কথাগুলো নাম উল্লেখ না করে আমি অনেকবার টেলিভিশন টকশোতে বলেছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ ক্রোড়পত্রের জন্য একটি লেখা চেয়ে স্যারকে ফোন করেছিলাম গত ফেব্রুয়ারির কোনো একদিন। এ মুহূর্তে তারিখ মনে নেই। স্যার জানালেন, তিনি সিঙ্গাপুরে আছেন স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য। স্যারের স্ত্রী ছিলেন মরণব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত। তাঁর নিজেরও শরীর ভালো না বলে জানান। তার পরও আমার অনুরোধ রক্ষা করে সিঙ্গাপুর থেকে ‘শিক্ষার সংস্কৃতি কেন গুরুত্বপূর্ণ’ শিরোনামে একটি অসাধারণ লেখা লিখেছিলেন, যা এ বছর ১৬ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে ছেপেছিলাম। নিজের সাধ্য ও সামর্থ্যমতো স্ত্রীর সুচিকিৎসা করার চেষ্টা করেছেন; কিন্তু বুঝতে পারেননি কখন যে নিজের হৃদয় অচল হয়ে যাচ্ছে। প্রিয় বাংলাদেশকে, দেশের মানুষকে, তাঁর শিক্ষার্থীদের এবং তারুণ্যকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। তাঁর ভালোবাসার প্রিয় দেশ, বিপ্লবের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে আশঙ্কা তিনি করেছিলেন, আজ মনে হচ্ছে আমরা সেদিকেই যাচ্ছি। একটি সুন্দর আগামীর জন্য ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্টের পতন ঘটিয়েছে। যে বিপ্লবে ৫ আগস্ট হয়েছে, এমন তারুণ্য পৃথিবীর অনেক দেশই দেখেনি। যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে, সে দেশগুলো বিপ্লবের ফসল ঘরে তুলেছে। নতুনভাবে দেশ গড়ে তুলেছে। কিন্তু আমরা ১৪ মাসেও একটি নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি। বিগত ১৬ বছর জনগণের ভোটাধিকার ছিল না বলেই ফ্যাসিস্টের জন্ম হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে, অনেকে পঙ্গু হয়েছেন। যে পিতা-মাতা সন্তান হারিয়েছেন, কেবল তাঁরাই জানেন তাঁদের কী হারিয়েছে। যে পরিবারের সন্তান পঙ্গুত্ববরণ করেছে, শুধু তারাই জানে পঙ্গু মানুষটি পরিবারের জন্য কতটা বেদনার বোঝা। অন্যদিকে নতুন বন্দোবস্তের নামে বানরের পিঠা ভাগের মতো ক্ষমতার ভাগবাঁটোয়ারার কূটকৌশল নিয়ে এখন সবাই ব্যস্ত। ক্ষমতা নিশ্চিত না করে কেউ নির্বাচনে যেতে চায় না। দেশ ও জনগণ নিয়ে ভাবার সময় কারও নেই। বিপ্লবীরা যাদের ওপর আস্থা রেখে দেশের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তারা নিজের আখের গুছিয়ে সেফ এক্সিট খুঁজছেন। সেই সুবিধাবাদীদের নামও বিপ্লবীরা আকারে-ইঙ্গিতে বলেছেন। এমন দুর্ভাগ্য জাতির জন্য আর কী হতে পারে! তবে আশার কথা হলো, জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এ পর্যন্ত কেউ সেফ এক্সিট পায়নি। আশা করি সরকারের সুবিধাভোগীরাও সেই সুযোগ পাবে না। আমাদের দেশের সৌন্দর্য হলো রাজনীতিবদরা যখন পথ হারান, জনগণ সব সময়ই তাদের পথ দেখায়। কারণ জনগণ সব সময়ই দিতে প্রস্তুত, নিতে নয়। জনগণ সব সময়ই দান করে, দান গ্রহণ করে না।
নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। যেখানে গণতন্ত্র নেই, জনগণের ভোটাধিকার নেই সেখানে গণতন্ত্র নেই। যে জনপদে গণতন্ত্র যত বেশি শক্তিশালী, সেই দেশ বা জনপদ সবচেয়ে বেশি সভ্য। পাকিস্তানিরা গণতন্ত্র মানেনি বলেই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বৈষম্য। স্বাধীনতার ৫৪ বছর, দীর্ঘ সময়ের মধ্যে অভাগা বাঙালির ভাগ্যে এ দুটির একটিও জুটল না। না গণতন্ত্র, না বৈষম্যমুক্তি। দীর্ঘ ১৬ বছর যারা ক্ষমতায় ছিল তাদের সময় কেটেছে শুধু পিতার স্বপ্ন ও চেতনার দোকানদারি করে। সেই সঙ্গে ছিল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার নষ্ট কৌশল। তারা ভেবেছিল দেশটা তাদের পৈতৃক সম্পত্তি। তারা ভুলে গিয়েছিল, দেশের মালিক জনগণ। নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন-বঞ্চনা সহ্য করতে না পেরে একপর্যায়ে মানুষ তার রাষ্ট্রের মালিকানা ফেরত পেতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। জন্ম নেয় নতুন ইতিহাস, যার নাম জুলাই বিপ্লব। অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই বিপ্লবীদের মনোনয়নে গঠিত হয়েছে। এ সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন।
সংস্কার ও বিচার হলো দীর্ঘ ও চলমান প্রক্রিয়া। এ দুটি ইচ্ছা করলেই এক দিনে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আর ইচ্ছা করলেই এ সরকারের পক্ষে সব সংস্কার ও সব অপরাধীর বিচার সম্পন্ন করাও সম্ভব নয়। অনেক বিষয় আছে যেগুলো সম্পন্ন করতে নির্বাচিত সরকারের প্রয়োজন। বর্তমান সরকার ১৪ মাসের মধ্যে গবেষণা কাজেই বেশি সময় ব্যয় করেছে। নির্বাচনের সম্ভাব্য মাসের ঘোষণা সরকারের কাছ থেকে জনগণ পেয়েছে; কিন্তু দিনক্ষণ এখনো পাওয়া যায়নি। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন চলছে বানরের পিঠা ভাগাভাগি খেলা। সেই সঙ্গে উপদেষ্টাদের সম্পর্কে গোপন কথা প্রকাশ করছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অনেক উপদেষ্টা নিজের আখের গুছিয়ে এখন সেফ এক্সিট খুঁজছেন। এনসিপি নেতাদের বক্তব্য অসত্য, এটা জনগণ মনে করে না। কারণ জনগণের কাছে অনেক তথ্য আছে, যা সময় হলে নিশ্চয়ই প্রকাশ করবে। গণমাধ্যমও সবকিছু প্রস্তুত করে বসে আছে। লোহা যখন গরম হবে, তখনই আঘাত করা হবে। কারণ এ সরকারের উপদেষ্টারা হলেন বিপ্লবীদের বিশ্বস্ত ও আস্থাশীল ব্যক্তি। তাঁরা হলেন রাষ্ট্রের আমানতকারী। তাঁরা যদি আমানতের খেয়ানত করেন, তাহলে তাঁদের বিচার ফ্যাসিস্টদের মতো করেই হওয়া উচিত। তবে এটা নিশ্চিত, অনেক উপদেষ্টাকেই কোনো না কোনো দিন তাঁদের অপকর্মের জন্য জবাব দিতে হবে। একদিকে ফ্যাসিস্টদের বিচার করবেন, অন্যদিকে তাঁদের অবৈধ সম্পদ রক্ষা করবেন, তা তো কারও কাছেই কাম্য নয়। সে কারণেই বতর্মান পরিস্থিতি কোনো কোনো উপদেষ্টার সৃষ্ট কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। অনেকের ধারণা ‘শর্ষের মধ্যেই ভূত’।
অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল পবিত্র ওমরাহ করার। নানান কারণে এত দিন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এ মাসে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে ওমরাহ করার সুযোগ পেলাম। আল্লাহর ঘর পবিত্র কাবা শরিফের সৌন্দর্য, ইবাদতের প্রশান্তি প্রত্যেক মুসলমানের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। কাবাঘরের হাজরে আসওয়াদ পাথরের চারপাশে সাতবার ঘুরে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের পর আল্লাহর দরবারে হাত তুললে চোখের পানি এমনিতেই গড়িয়ে পড়ে। একজন পাপী বান্দা আল্লাহর কাছে যখন পাপমোচনের প্রার্থনা করে, তখন আল্লাহ যেভাবে পছন্দ করেন সেভাবেই চাইতে হয়। সব মুসলমান যারা ওমরাহ করতে এসেছেন, সবার মধ্যে একই রকম অনুভূতি লক্ষ করা যায়। সবাই অন্তরের সব আবেগ-ভালোবাসা দিয়েই স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আমিও চেষ্টা করেছি। মহান আল্লাহ আমাকে কীভাবে গ্রহণ করেছেন, সেটা তিনিই ভালো জানেন। মক্কা থেকে মদিনায় প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজায় যখন পৌঁছলাম, তখন আবার মনের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত হলো। যে নবীকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পৃথিবী, সৌরজগৎ কিছুই সৃষ্টি করতেন না, সেই নবীর রওজায় সালাম দেওয়ার সময়ও চোখের পানি বাঁধ মানেনি। লাখো মানুষ প্রতিদিনই আল্লাহর প্রেমে মক্কা-মদিনায় ছুটছে। শারীরিকভাবে সক্ষম-অক্ষম সকল পর্যায়ের মানুষই আপ্রাণ চেষ্টা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের। এ দুই পবিত্র স্থানে দুনিয়ার সব মুসলমানের জন্য দোয়া করেছি। আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান বসুন্ধরা গ্রুপ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, আমার সব সহকর্মী ও পাঠক-শুভানুধ্যায়ীর জন্যও দোয়া করেছি। সর্বোপরি দেশের জন্য দোয়া করেছি। মহান আল্লাহ যেন আমাদের দেশটা ভালো রাখেন। এ সফরে অনেকের সঙ্গেই সাক্ষাৎ হয়েছে। অনেকে এসেছেন নির্বাচনি ওমরাহ করতে। সবাই সবার মনের কামনা-বাসনা আল্লাহর কাছে পেশ করেছেন।
দেখা হয়েছে কাবাঘর ও নবীর রওজায় কর্মরত আমাদের দেশের অনেকের সঙ্গে। শুধু কাবাঘর নয়, আশপাশের চারদিকের রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ যে কত যত্ন নিয়ে আমাদের দেশের শ্রমিকরা করছেন, ভাবা যায় না। মক্কা ও মদিনার দুই পবিত্র ঘরের হাউস কিপিংয়ের কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশি ভাইদের পরিশ্রম দেখে অবাক হতে হয়। কি চমৎকার হাসিমুখে তাঁরা কাজ করছেন, বাংলাদেশি কারও উপকার করতে পারলে তাঁরা যেন ধন্য হয়ে যান। দুই স্থানেই তাঁদের সম্মান অনেক। অনেকের সঙ্গেই কথা হয়েছে। সবার একটাই কথা। তা হলো, তাঁরা দুনিয়া ও আখেরাতের কাজ একসঙ্গে করতে পারছেন। এ কাজটি করতে পেরে তাঁরা নিজেদের ধন্য মনে করছেন। এমন পবিত্র স্থানে কাজ করার সৌভাগ্য কজনের হয়! তাঁদের জন্য আমিও গর্বিত। তবে কিছু কষ্টের বিষয়ও আছে। তাঁরা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে বাংলাদেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠান। তাঁদের টাকায় আমাদের রেমিট্যান্স হিসাবের অঙ্ক বাড়ে। আমাদের সরকারের বাহাদুরিও বাড়ে। কিন্তু এ জনসম্পদকে যদি আরও দক্ষ করা যেত, আরবি ভাষা শেখানো যেত, আমাদের দূতাবাস যদি তাদের খবর নিত তাহলে তাঁরা আরও ভালো থাকতে পারতেন।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন, মদিনা থেকে [email protected]