আগামীকাল জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। সব রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশের জন্য জাতীয় সনদে পরিণত হবে এটি। তবে শেষ মুহূর্তেও জুলাই জাতীয় সনদের বিভিন্ন বিষয়ে একমত হতে পারেনি দলগুলো। বেশ কিছু দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না বলে গতকাল ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে জানিয়েছে। কয়েকটি দল স্বাক্ষরের ব্যাপারে ধোঁয়াশা রেখে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। দুই দিনের ইতালি সফর শেষে গতকাল সকালে ঢাকায় পা রাখেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিকালেই জুলাই সনদের সবশেষ অবস্থা জানতে ঐকমত্য কমিশনের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সন্ধ্যায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আকস্মিক জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দল অংশ নেয়।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আগামী ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। সবাইকে নিয়ে উৎসব-মুখরভাবে নির্বাচন করতে চায় সরকার। এমন একটি নির্বাচন করে দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। যে অসম্ভবকে আপনারা সম্ভব করেছেন সেটা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে না, পৃথিবীর রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। আপনারা কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সমাধানে এসেছেন।’
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘আমরা চাই না প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর মধ্যে কোনো রকমের ভারসাম্য নষ্ট হোক। আমরা সেটি অ্যাফোর্ড (সামলে নেওয়া) করতে পারব না এই মুহূর্তে। আমরা চাই, আপনার সাথে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সুসম্পর্ক বজায় থাকুক। রাষ্ট্র একটা ব্যালান্সড অবস্থায় থাকতে হবে। আমরা নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো রকমের ঝুঁকির মধ্যে যেতে চাই না। যেতে পারব না। সেটা আমরা অ্যাফোর্ড করতে পারব না।’
বৈঠক শেষে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব, তবে নোট অব ডিসেন্ট যেগুলো আছে তা উল্লেখ থাকতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘সব প্রস্তাবে যদি সবাই একমত হতো, তাহলে আলোচনার প্রয়োজন পড়ত না। আমরা আশা করি ১৭ অক্টোবর জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হবে এবং সেটি জাতির সামনে প্রকাশ করা হবে।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। যে কোনো উপায়েই হোক ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। জুলাই সনদে স্বাক্ষর হলেও পরবর্তীতে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তাদেরই এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এ সনদের আইনি ভিত্তি জাতীয় সংসদের ওপর নির্ভর করবে।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব। এটা নিয়ে এখনো অনেক মতানৈক্য আছে। আমরা অনুরোধ করেছি মতানৈক্য দূর করে নোট অব ডিসেন্ট যাতে একটু কমিয়ে আনা যায়।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘গণভোট আর জাতীয় নির্বাচন আলাদা বিষয়; এক দিনে করার প্রস্তাব উদ্ভট আলোচনা। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নভেম্বরে গণভোট দিতে হবে।’
তাহের বলেন, ‘বিএনপি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে আগে দ্বিমত করলেও এখন আগ্রহ দেখাচ্ছে। এজন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ।’
তিনি বলেন, ‘যেসব বিষয়ে আমরা এক জায়গায় আসছি এবং এনসিসি সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সেসব একটা প্যাকেজ করে তার ওপর গণভোট হবে। এখন গণভোট কখন হবে এ নিয়ে আবার আমাদের ভিতরে কিছুটা ডিফারেন্স। আমরা বলেছি গণভোট হচ্ছে রিফর্মস কমিশন কমিটির জন্য। এটা আলাদা বিষয় আর জাতীয় নির্বাচন একটি আলাদা বিষয়।’
জামায়াত নেতা বলেন, ‘নির্বাচনের আগেই ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবে এবং তার আলোকে জাতীয় নির্বাচনে আপার হাউসের ভোট হবে। যদি এটা নির্বাচনের দিনেই হয় যা কেউ কেউ চাচ্ছে, নির্বাচন একসঙ্গে তাহলে তো আপার হাউস নির্বাচন দিন পর্যন্ত আর পাস হইল না।’ তিনি বলেন, ‘এক দিনে জাতীয় ও গণভোট হলে ভোট কাস্টিং একেবারেই অপ্রতুল হবে। কারণ সেদিন গণভোটের কোনো গুরুত্বই থাকবে না।’ তাহের বলেন, ‘আশা করি ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাব এবং এতে অনিশ্চয়তা দেখি না।’
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘আমরা দাবি জানিয়েছি জাতীয় নির্বাচন এবং জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট এক দিনেই হতে হবে। আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব। প্রধান উপদেষ্টা মূলত জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করায় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এ বৈঠক ডেকেছিলেন। তিনি আবারও নিশ্চিত করেছেন যে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন হবে।’ রাশেদ খান বলেন, ‘অবশ্যই জুলাই সনদে সবার স্বাক্ষর করতে হবে। যারা স্বাক্ষর করবে না, তারা জাতির কাছে আজীবন দায়ী থাকবে।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘১৭ অক্টোবর বাসদ, বাসদ মার্কসবাদী, সিপিবিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোটের পাঁচটি দল জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করবে না।’ তিনি বলেন, ‘কথা ছিল যেসব বিষয়ে সব দলের মধ্যে ঐকমত্য হবে, সেগুলো নিয়েই জুলাই জাতীয় সনদ হবে। এখন দেখলাম বিভিন্ন দলের অসংখ্য নোট অব ডিসেন্টসহ জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তাহলে এ সনদ বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? এ ছাড়া আমরা যেসব বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিলাম, সেগুলো জুলাই সনদে বিবেচনা করা হয়নি।’ এ ব্যাপারে আজ সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে বলে জানান তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি বিবেচনাধীন। সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াসংক্রান্ত কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতার কারণে শেষ মুহূর্তে সংশয় তৈরি হয়েছে। জাতিকে অস্পষ্ট রেখে কোনো উদ্যোগ সফল করা সম্ভব নয়। আমরা জুলাই ১৬ তারিখে যে খসড়াটি পেয়েছি, সেখানে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো পরিষ্কার করা হয়নি।’ এনসিপির এই নেতা বলেন, ‘গণভোটের ব্যাপারে আমরা যে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছি, সেই গণভোটের প্রশ্ন এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। গণভোটের দিন-তারিখসহ বিষয়গুলো জাতির কাছে এবং আমাদের কাছেও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মূল লক্ষ্য জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ পরিষ্কার করা, তার পরই আমরা সনদ স্বাক্ষরের দিকে অগ্রসর হব।’ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন বলেন, ‘শুক্রবার হতে যাওয়া জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব কি না অনিশ্চিত। এক দিন সময় আছে অর্থাৎ আজ (বৃহস্পতিবার) আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বলেছি নোট অব ডিসেন্ট থাকতে পারবে না। যেসব দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে তারা আগে এগুলো প্রত্যাহার করবে তার পরে স্বাক্ষর। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের আর এক দিন বাকি আছে, আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। যদি সম্ভব হয় স্বাক্ষর করব। আমরা বলেছি নির্বাচন ও গণভোট যেন একই দিনে না হয়। আর নভেম্বরের মধ্যে গণভোট দিতে প্রধান উপদেষ্টাকে আমরা অনুরোধ করেছি।’
যে কলমে সই করা হবে সেগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে : প্রধান উপদেষ্টা
অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘জুলাই সনদ সই হয়ে গেলেই শেষ হয়ে যাবে না। এটা মস্তবড় একটা অধ্যায় শেষ হলো। কিন্তু আরও বহু অধ্যায়ের সূত্রপাত শুরু করবে। কাজেই সেভাবেই আমরা এগোব, যাতে এটা কোথাও হারিয়ে না যায়। পাঠ্যবইসহ নানান জায়গায় এটা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করতে হবে।’ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘যে দলিলগুলো আপনারা তৈরি করেছেন সেগুলো হারিয়ে যাবে না। আমি যত দিন পারি চেষ্টা করব এগুলো যেন প্রত্যেকের কাছে যায়। যেন সবার মনের মধ্যে থাকতে পারে কেন আমরা একমত হতে পেরেছি। একমত হওয়া এক জিনিস, এটাকে সঞ্চারিত করা এক জিনিস। এ সঞ্চারণের দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে সরকার হিসেবে, আমরা প্রক্রিয়া শুরু করব। বিষয়গুলো জনগণের কাছে প্রচার করার মতো ভাষায় প্রচার করতে হবে। আমি বলে রেখেছি, আপনারা যে বিতর্কগুলো করেছেন এগুলো অমূল্য সম্পদ। এগুলোকে বিষয়ভিত্তিকভাবে ভিডিও করে, বই করে আমাদের কাছে থাকবে, যাতে হারিয়ে না যায়। সমাজমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রচার করলে সবার কাছে পরিষ্কার হবে।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যে অসম্ভবকে আপনারা সম্ভব করেছেন সেটা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে না, পৃথিবীর রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। আপনারা কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সমাধানে এসেছেন। নিজেরা সবাই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন, একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছেন। এজন্য আজকে জুলাই সনদ রচনা হয়েছে। সেজন্য আমি একা নই, জাতির সবাই অভিভূত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আজকে যে পয়েন্টে এসেছি, সেটা একটা অবিশ্বাস্য কাণ্ড। মানুষ চিরদিন স্মরণ করবে, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে গর্ববোধ করবে। আমি একজন ব্যক্তি হিসেবে গর্ববোধ করছি যে এ কাজের সঙ্গে আমি শরিক ছিলাম, অংশীদার ছিলাম। যে অসম্ভব কাজ আপনারা করলেন এটা যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো একটা দিন।’ প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান তার পরে এটাই মনে হয় সঠিকভাবে রচিত হলো। কাজেই জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানে সারা জাতি শরিক হবে। যে কলমে সই করা হবে সেগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। যে যে কলম দিয়ে সই করবেন তার তার মুহূর্ত জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। কারণ কেউ ভুলতে পারবে না আপনাদের। এটা এমন একটা ঘটনা, আমরা যেহেতু ঘটনার ভিতরে আছি বলে অনুভব করতে পারছি না। বাইরে গিয়ে যদি দাঁড়াতে পারতাম তাহলে মনে হতো বিশাল একটা কাজ। মাসের পর মাস বৈঠক করে হয়তো মনে করেছেন এটা অসমাপ্ত থেকে যাবে। এটা অসমাপ্ত থেকে যায় নাই। সন্তোষজনকভাবে আপনারা সমাপ্তিতে এনেছেন। আপনারা ভেবেচিন্তে নিয়মকানুন বের করেছেন যাতে সবাই সনদে সই করতে পারেন। এটা জাতির জন্য একটা মস্তবড় সম্পদ রয়ে গেল। এজন্য আপনাদের সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনারা সবাই যে পরিশ্রম করেছেন, তা জাতি হিসেবে সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’