রাজধানীর বাংলাবাজার থেকে পোস্তগোলা যাওয়ার পথে ‘নর্থব্রুক হল রোড’। ব্যস্ততম এই রাস্তার একপাশের নালার ওপর ছোট ছোট স্ল্যাব দেওয়া, তবে প্রায় স্ল্যাব ভাঙা ও ময়লার ভাগাড়ে ভরপুর। আরেক পাশের ফুটপাত এতটাই সরু, দুজন মানুষ মুখোমুখি হলে একজনকে রাস্তায় বাধ্য হয়ে নামতে হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ওই এলাকার রাস্তা মোটামুটি বড় হলেও পথচারী হাঁটার জন্য আলাদা কোনো ফুটপাত নেই। তার পাশের প্যারিদাস রোডেও একই দৃশ্য। ব্যস্ততম এলাকা হওয়া সত্ত্বেও সড়কগুলোর দুই পাশে ফুটপাত না থাকায় রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন পথচারীরা। রাস্তার পাশ দিয়েই ঘেঁষা অনেক দোকান। সেখানেও খদ্দেরের ভিড়ে সাধারণ মানুষের হাঁটাচলা করতে বেগ পেতে হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এক সময় রাস্তার দুই পাশে ফুটপাত ছিল। লোকজন অনায়াসেই যাতায়াত করতেন। কিন্তু রাস্তা বড় ও উঁচু হতে হতে এখন ফুটপাত প্রায় অদৃশ্য। নালার স্ল্যাব কিছু অংশে ভেঙে পড়ায় সেদিকে হাঁটাচলা অনিরাপদ। তাই পথচারীদের বাধ্য হতে হচ্ছে রাস্তায় হাঁটতে।
স্থানীয় বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম, যিনি ১৫ বছর ধরে নর্থব্রুক হল রোডের পাশে থাকেন। কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। তিনি বলেন, আগে দুই পাশেই হেঁটে যাওয়ার মতো ফুটপাত ছিল। রাস্তা প্রশস্ত করতে করতে ফুটপাতটাই শেষ করে দিয়েছে। বাচ্চা নিয়ে হেঁটে যাওয়া তো দূরের কথা, একা মানুষও নিরাপদ নয়। সবাই রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়, তারপর দুর্ঘটনার ভয়।
একই এলাকার দোকানি মোজাম্মেল হক একই ক্ষোভ জানালেন। তার দোকানের সামনের জায়গাটুকু একসময় ফুটপাত ছিল। তিনি বলেন, রাস্তাটা বড় হলো, কিন্তু আমাদের হাঁটার জায়গাটা গেল কোথায়? মাঝে মাঝেই দেখি, বৃদ্ধ বা স্কুলের বাচ্চারা গাড়ির হর্নে ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে। দোকানের সামনে জায়গা না থাকায় খদ্দেররা একটু দাঁড়ালেই গাড়ির জট লেগে যায়। রাতুল আহমেদ নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, ফুটপাত এত সরু যে একা হাঁটাও কঠিন। ফুটপাত তো থাকার কথা। আমরা বাধ্য হয়ে এখন রাস্তায় গাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটি। এদিকে সরেজমিনে মালিবাগ থেকে খিলগাঁও যাওয়ার রাস্তায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। ফ্লাইওভারের কাজ ও রাস্তা উঁচু করায় সেখানকার ফুটপাত অনেক সরু হয়ে গেছে। যেখানে একসময় প্রশস্ত ফুটপাত ছিল, এখন সেটুকু সংকীর্ণ হয়ে গেছে। বড় বড় বাস আর মোটরসাইকেলের ভিড়ে পথচারীরা আতঙ্ক নিয়ে হাঁটেন। নর্থব্রুক-প্যারিদাস রোড, মালিবাগ বা খিলগাঁওসহ ঢাকার প্রায় অনেক এলাকায় এমন অনেক সড়ক আছে যার দুই পাশের ফুটপাত দিন দিন সরু হচ্ছে। রাস্তাগুলো যত প্রশস্ত হচ্ছে, হাঁটার জায়গা তত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানের শহরগুলোয় রাস্তা প্রশস্ত করলেও ফুটপাতের ন্যূনতম প্রস্থ ১ দশমিক ৮ মিটার রাখা হয়। ঢাকায় তা অনেক জায়গায় অর্ধেকেরও কম। ফলে পথচারীরা বাধ্য হয়ে গাড়ির সঙ্গে একই রাস্তায় ভাগ বসান। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে, ট্রাফিকও বিশৃঙ্খল হয়। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে ফুটপাত সংকীর্ণ করা মানে শুধু দুর্ঘটনার ঝুঁকি নয়, জনজীবনের স্বাভাবিক চলাচলকেই বাধাগ্রস্ত করা। আন্তর্জাতিক মানের যে ফুটপাত থাকার কথা ঢাকায় তার অর্ধেকও নেই।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ফুটপাত রাষ্ট্র সংরক্ষণ করবে। এটা রাষ্ট্রের সম্পদ। কিন্তু সেই ফুটপাতই এখন সবচেয়ে বড় অবহেলিত। একদিকে দখলদারির কবলে পড়ে রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ ফুটপাত দখল হয়ে গেছে।
অন্যদিকে ফ্লাইওভার থেকে শুরু করে ফুটওভার ব্রিজ-রাস্তার মতো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও ফুটপাতকে ক্রমশই ছোট করা হচ্ছে। অনেক জায়গায় তো ফুটপাতই নাই হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, একদিকে আমরা ঢাকাকে মেগাসিটি হিসেবে বিশ্ববাসীকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, অন্যদিকে কোনো পলিসিই মানছি না। রাস্তার দুই পাশে দুজন মানুষ পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার জায়গা থাকা বাধ্যতামূলক। তবে তা আমরা কতটুকু মানছি। পলিসিতে পথচারী বিবেচিত হচ্ছে না। নগর পরিকল্পনায় পথচারীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু আমাদের প্রকল্পগুলোতে প্রাধান্য পায় গাড়ি। রাস্তা প্রশস্ত করা, ফ্লাইওভার বানানো এসবের নকশায় ফুটপাত রক্ষার বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়।