নানা অনিয়মের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) নির্বাচন। গতকাল সকাল ৯টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়ে চলে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। আজ ফলাফল ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ওএমআর পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ হওয়ায় দ্রুত ফলাফল প্রকাশের আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।
তবে ভোট গ্রহণের শেষ পর্যায়ে বেশ কিছু কেন্দ্রে অনিয়ম, কারচুপি, গণনার সময় এলইডি বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা অভিযোগ তুলেছে বিভিন্ন প্যানেল। একটি প্যানেল ভোট বর্জন করেছে। পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় অন্যান্য প্যানেলও। এলইডি স্ক্রিন বন্ধ হয়ে গেলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় জড়ান ছাত্রদল ও শিবির কর্মীরা। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের বাইরে হাটহাজারীর এগারোমেইল এলাকায় শিবির সমর্থিত বহিরাগতদের ধাওয়া দিয়েছে স্থানীয়রা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেলগেট এলাকায় আশপাশের ছাত্রদল সমর্থিত বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে অবস্থান নিতে দেখা গেছে।
চাকসু নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. কে এম আরিফুল হক সিদ্দিকী বলেন, ‘পাঁচ অনুষদ ভবনের ১৫ কেন্দ্রে চাকসু, হল ও হোস্টেল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আনুমানিক ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে।
ভোট গণনা শেষে চূড়ান্তভাবে ফলাফল ঘোষণা করা হবে।’ আইটি সেলের প্রধান অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী জানান, ‘ভোট গণনা চলছে, যা সম্পূর্ণ হতে ৮-৯ ঘণ্টা লাগতে পারে। ভোট গণনা তিন ধাপে সম্পন্ন হচ্ছে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে চলছে।’
এদিকে সকালে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন হৃদয়, জিএস শাফায়েত হোসেন, শিবিরের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনিসহ কয়েকটি প্যানেলের প্রার্থীরা অমোচনীয় কালি ব্যবহার না করার কারণে অভিযোগ করেন নির্বাচন কমিশনে। (চাকসু) নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন বলেন, ‘সারা দেশে খুঁজে আমরা এর থেকে ভালো কালি আর পাইনি। সেজন্য আমাদের দায়সারা গোছের একটা কালি দিতে হয়েছে। এটা আমাদের জাতীয় অক্ষমতা। ডাকসুতে যে সমস্যা হয়েছে, জাকসুতে যে সমস্যা হয়েছে, এখানেও সেই সমস্যা।’
ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলনে অনিয়মের অভিযোগ : ভোট গ্রহণ শেষে সন্ধ্যা ৭টায় সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল চাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে। অভিযোগুলো হলো ১০০ গজের মধ্যে বিভিন্ন প্রার্থী ভোট চেয়েছেন এবং ভোটারদের হাতে স্লিপ বিতরণ করেছেন। ভোটের কালি সহজেই মুছে গেছে। অনেক ব্যালটে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার স্বাক্ষর নেই। দুপুর ১২টার দিকে ৪০-৪৫ মিনিট এলইডি স্ক্রিন বন্ধ ছিল।
ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আশ্বাস সত্ত্বেও এলইডি স্ক্রিন ও ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করেনি।’ এমনকি কমিশন আগের দিন প্রজেকশন মিটিংয়ে মাইক ব্যবহার করে নিয়ম ভঙ্গ করেছে বলেও দাবি করা হয়। জিএস প্রার্থী শাফায়েত হোসেন বলেন, ‘আমাদের আইডি কার্ড ও ছবি দেখেও কিছু ভোট গ্রহণকারী স্বাক্ষরহীন ব্যালট দিয়েছেন। ফরহাদ হলে ৪৩১ ও ৪৩২ নম্বর বুথে এক নারী সদস্যের স্লিপ বিতরণের প্রমাণ আছে। নতুন কলা অনুষদে আমাদের ওপর লাঠি ও বাঁশ নিয়ে হামলার চেষ্টা হয়।’
ছাত্রদলের প্যানেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ শিবিরের ভোট গ্রহণ শেষে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনি অভিযোগ করেছেন, ‘ভোট কেন্দ্রে ছাত্রদলের আলাওল হলের জিএস প্রার্থীসহ অনেকের সঙ্গে বহিরাগতদের দেখা গেছে। অথচ পরিচয়পত্র ছাড়া কেউই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের কথা নয়। প্রশাসন বহিরাগতদের আটকাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।’ আচরণবিধি লঙ্ঘন করার পরও ছাত্রদল নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তিনি পক্ষপাতের অভিযোগ তোলেন।
ভোট বর্জন ও অনিয়মের অভিযোগ কয়েকটি প্যানেলের : সংবাদ সম্মেলন করে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ব ইনসানিয়াত বিপ্লব স্টুডেন্ট ফ্রন্ট সমর্থিত ‘রেভ্যুলেশন ফর স্টেট অব হিউম্যানিটি’ প্যানেলের ভিপি প্রার্থী কেফায়েত উল্লাহ। নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট গণনা স্থগিতের দাবি জানিয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সম্মিলিত প্যানেল ‘দ্রোহ পর্ষদ’। ভোট গ্রহণ শেষে সংবাদ সম্মেলন করে বামধারার শিক্ষার্থীদের আরেকটি প্যানেল ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য’ অভিযোগ করেছে, কিছু ঘটনা চাকসু নির্বাচন কলঙ্কিত করেছে। এসব অনিয়মের বিচার ও তদন্ত দাবি করে এ প্যানেলটি। তবে অভিযোগ তুললেও তারা ভোট বর্জন করছে না বলে জানিয়েছেন প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ধ্রুব বড়ুয়া। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি ভোট গ্রহণ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ‘১০০ মিটারের মধ্যে প্রচার চালানোর নিয়ম না থাকলেও সকাল থেকে ছাত্রশিবিরের নেতারা টেবিল বসিয়ে প্রচার চালিয়েছেন।
বিএনপি-ছাত্রদল ও জামায়াত-ছাত্রশিবির মুখোমুখি : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের অক্সিজেন-হাটহাজারী সড়কের ১ নম্বর গেট এলাকায় রাত থেকে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে বিএনপি-ছাত্রদল ও জামায়াত-ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়।
রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট এলাকায় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা স্লোগান দিতে দেখা যায়। কিছুটা দূরে অবস্থান করছিল ছাত্রশিবিরের সমর্থকেরা। ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ, বিজিবি ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। রয়েছে পুলিশের একটি সাঁজোয়া যানও।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হাটহাজারী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘জামায়াত–শিবিরের বহিরাগতরা এসে ১ নম্বর গেটে অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচনে কারচুপি ও নানা অনিয়ম হয়েছে। সে কারণেই আমরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়েছি।’ তবে ঘটনাস্থলে থাকা জামায়াত–শিবিরের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তাঁরা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী তারেক আজিজ বলেন, ‘এক নম্বর গেট এলাকায় দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। তবে এখনো কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। আমরা তাঁদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে অনেকেই সরে গেছেন।’