জাপানের দীর্ঘদিনের জনসংখ্যা সংকট মোকাবিলার লড়াইয়ের মাঝেই এই সপ্তাহে এক চমকপ্রদ খবর এলো। ২০২৪ সালে, দেশটিতে বিদেশি বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা গড়ে ২২ হাজার ছাড়িয়েছে। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৩ হাজার বেশি এবং এক দশক আগের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।
কিন্তু এই 'বেবি বুম'-এর নেপথ্যে থাকা মায়েরা কেউই জাপানি নন। চীন, ব্রাজিল, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনামের নারীদের ঘরে আসা শিশুদের কলরব জাপানের মাতৃত্বকালীন ওয়ার্ডগুলোতে এখন যেন ভিন্ন এক বার্তা দিচ্ছে। এই ঘটনা স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয় যে, জাপানের রক্ষণশীল পুরুষ রাজনীতিবিদদের বারবার আহ্বান সত্ত্বেও জাপানি দম্পতিদের মধ্যে সন্তান ধারণের প্রবণতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারগুলোর প্রচেষ্টা কতোটা ব্যর্থ হয়েছে!
একদিকে যখন বিদেশিদের ঘরে রেকর্ড সংখ্যক শিশুর জন্ম হচ্ছে, ঠিক তখনই জাপানি বাবা-মায়ের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৮৬ হাজারে। যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ৪১ হাজার কম।
অভিবাসনের ঢেউ ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা
জনসংখ্যার এই চিত্রে আরও যোগ হয়েছে বিদেশি জনসংখ্যার বৃদ্ধি। বর্তমানে জাপানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩.২ শতাংশ বা প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বিদেশি। যা এক দশক আগেও ছিল প্রায় অকল্পনীয়।
এই অভিবাসনের ঢেউ আকস্মিক নয়। সাত বছর আগেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে শ্রম সংকট মোকাবিলায় আরও বেশি দক্ষ কর্মী নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছিলেন। ফলস্বরূপ, বর্তমানে জাপানের শহর থেকে শুরু করে জনশূন্য গ্রামীণ অঞ্চল পর্যন্ত কনভেনিয়েন্স স্টোর, রেস্তোরাঁ, কারখানা, নির্মাণ কাজ, কৃষি ও মৎস্য খাতে অভিবাসীরা অপরিহার্য কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। সাকোকু বা স্ব-আরোপিত বিচ্ছিন্নতার দেশ হিসেবে জাপানের আগের পরিচিতি এখন তাই অচল।
অভিবাসন নিয়ে বাড়ছে রাজনৈতিক বিভাজন
বিদেশিদের আগমন জাপানের রাজনীতিতে নতুন করে অভিবাসন বিতর্ক উসকে দিয়েছে। সম্প্রতি ডানপন্থী ছোট দল সানসেইতো জাপানিজ ফার্স্ট স্লোগানকে সামনে রেখে নির্বাচনে তাদের শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, এই উত্থান স্বল্পস্থায়ী হতে পারে তবুও দলটি অভিবাসন বিতর্কের সুর সেট করে দিয়েছে।
ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টিসহ প্রায় সব প্রধান দলই বিদেশি কর্মীদের নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এমনকি এলডিপির নতুন নেত্রী সানায়ে তাকাইচি তার প্রচারণার শুরুতে অশালীন বিদেশি পর্যটকদের বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করেন, যদিও সেই মন্তব্যের সমর্থনে কোনো প্রমাণ ছিল না। অন্যান্য রাজনীতিবিদরা প্রায়শই বিদেশিরা জাপানিদের চাকরি কেড়ে নিচ্ছে বা অপরাধ বাড়াচ্ছে। এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে জনমত তৈরির চেষ্টা করছেন।
এই বিতর্ক মাঝেমধ্যে বিদেশি-বিদ্বেষে রূপ নিচ্ছে। টোকিওর কাছে কাওয়াগুচিতে কুর্দি বাসিন্দারা ঘৃণাভাষণ ও ভুল তথ্যের শিকার হয়েছেন। এমনকি আফ্রিকার কয়েকটি দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিময় কর্মসূচিও গুজব ও ভুল ধারণার কারণে বাতিল করতে বাধ্য হয় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা কি রাজনীতিকে ছাপিয়ে যাবে?
রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক বাস্তবতা ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে। ব্যবসায়িক নেতারা দৃঢ়ভাবে বলছেন, অভিবাসী কর্মীরা না থাকলে জাপানের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
বিশ্লেষকদের মতে অভিবাসন এমন দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকবে যে, আগামী ১৫ বছরের মধ্যেই বিদেশিরা জাপানের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের এরও বেশি হতে পারে। যা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে প্রায় তিন দশক আগেই ঘটবে।
এই পরিস্থিতিতে জাপানের রাজনীতিবিদদের সামনে কঠিন প্রশ্নটি হলো তারা কি অর্থনৈতিক পতন মেনে নেবেন, নাকি দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে একটি আরও বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যাকে স্বাগত জানাবেন?
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল