নিউরোইন্টারভেনশন নিউরোলজির একটি বিশেষায়িত শাখা। স্ট্রোকের আধুনিক চিকিৎসা দেওয়ার পাশাপাশি মাথা না কেটে মস্তিষ্কের অপারেশন করাই এই বিভাগের কাজ। এমবিবিএস পাস করার পর থেকেই আমার আগ্রহ জন্মায় ইন্টারভেনশনে কাজ করার। অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেই নিউরোইন্টারভেনশন নিয়ে কাজ করব। এ কারণে নিউরোলজি সাবজেক্ট কে বাছাই করি। নিউরোলজির এমডি কোর্সের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যারা নিউরোইন্টারভেনশন নিয়ে কাজ করেন তাদের সাথে যোগাযোগ করি। এমডি পাশের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণার বিষয়ও নেই নিউরোইন্টারভেনশন কেন্দ্রিক। পাস করার পর একজন অধ্যাপকের কাছে কাজ শিখতে যাই। কিন্তু উনি যে ঘৃণ্য আচরণ করলেন তা আমাকে পিছিয়ে দেয়ার পরিবর্তে আরোও উদ্যোমী করলো। কিন্তু কোন সুযোগ পাচ্ছিলাম না। পরে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শিরাজী শফিকুল ইসলাম স্যারের সাথে একটা অনুষ্ঠানে দেখা হয়, কথা হয়। আমার আগ্রহের কথা জানালাম। উনিও খুশি হলেন। আমাকে নিনসে যোগাযোগ করতে বললেন। স্যারের সাথে নিনসে দেখা করলাম। স্যার ও আমার শ্বশুরের সহায়তায় নিনসে পোস্টিংয়ের পর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন খান ও অধ্যাপক কাজী মহিবুর রহমান স্যার বেশ সাপোর্ট করেছেন।
নিনসে জয়েন করার পর ভয় ছিল ডিপার্টমেন্ট থেকে কখনো সরিয়ে দেয় কিনা। এজন্য এত বেশি পরিশ্রম করতাম যে সবাই যেন মনে করে এ কামলাকে সরালে ডিপার্টমেন্ট ঝামেলায় পড়বে। লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে ও কাজে সততা থাকে তাহলে আল্লাহ সাহায্য করেন। ডিপার্টমেন্টে ডা. শিরাজী স্যার আমাকে ছেলের মত আগলে রেখেছেন।
করোনার সময় ২০২২ সালে জাপানে যাওয়ার সুযোগ হলো। নিউরোইন্টারভেনশন নিয়ে বড় আন্তর্জাতিক প্রোগ্রাম। সেটাই আমার প্রথম দেশের বাইরে একাডেমিক যাত্রা। বিশ্বের নামকরা নিউরোইন্টারভেনশনিস্টদের সাথে সাক্ষাৎ। অনেকটা স্বপ্নের মত লাগছিল। সেখানেই পরিচয় প্যারিসের বিখ্যাত হাসপাতাল বিসেট হাসপাতালে নিউরোইন্টারভেনশনের অধ্যাপক লরেন্ট স্পিলের সাথে। তার সাথে কথা বললাম আমি তোমার সাথে ফেলোশিপ করতে চাই। উনি রাজী হলেন। বললেন যোগাযোগ করতে। আমি দেশে এসে ডিপার্টমেন্টে কথা বললাম। কিন্তু কোন কারণে না বলে দেয়া হলো। কাজেই প্রফেসর লরেন্টের সাথে আর যোগাযোগ করা হলো না। ডিপার্টমেন্টের কথা মতো প্যারিসের অন্য প্রফেসরের সাথে যোগাযোগ করলাম। উনি রাজি হলেন।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর ইন্টারভেনশনাল এন্ড থেরাপিউটিক নিউরোরেডিওলজি (WFITN) আমাদের মতো দেশের তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য স্কলারশিপ দিয়ে থাকে। এ সংস্থার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক তানাকা। উনি জাপানের মানুষ। খুব ভালো। জাপানে ওনার সাথে অনেক কথা হয়েছে। আমার স্কলারশিপের ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। উনি হেল্প করার কথা বলেছিলেন। স্কলারশিপের জন্য আবেদন করলাম। কিন্তু সমস্যা বাধলো অন্যখানে। ওই সময় ওই সংস্থার এডুকেশন গ্রান্টের চেয়ারম্যান ছিলেন ভারতের অধ্যাপক শাকের হোসাইন। উনি আমাকে দিবেন না তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ১ বছরের বেশি সময় পার হলেও কোন সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না। অবশেষে আমি অধ্যাপক তানাকার সাথে যোগাযোগ করি। উনি আমাকে জানালেন সেপ্টেম্বরে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করবেন।
এদিকে অধ্যাপক শাকের হোসাইন আমাকে নিয়ে নোংরা খেলা খেলেন। আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক অধ্যাপকের সাথে যোগাযোগ করে জানান যে আমাকে অভিনন্দন জানাতে। আমি স্কলারশিপ পেয়েছি। তার কথা মত আমাদের দেশীয় একটি কনফারেন্সে ঘোষণা দেয়া হলো আমি স্কলারশিপ পেয়েছি। ৭ দিন পর মেইল পাই। তাতে লেখা আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ৭ দিন সারাক্ষণ মন খারাপ থাকতো। একজন প্রফেসর এতো নিচু মানসিকতার হতে পারেন তা অধ্যাপক শাকির হুসেনকে না দেখলে বুঝতাম না। খুব আহত হয়েছিলাম কিন্তু ভেঙে পড়ি নাই। আমি নিজেকে চিনি। আমি যেটা চাই শত আঘাতেও আমাকে টলানো যায় না। এবার ডিপার্টমেন্টের বাইরে গিয়ে নিজের মতো দেশের বাইরে যোগাযোগ শুরু করলাম। অধ্যাপক লরেন্ট স্পিলের সাথে ই-মেইলে যোগাযোগ হলো।
গত বছর স্ট্রোকের ওপর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ইস্তাম্বুলে যাই। সেখানেই একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে অধ্যাপক লরেন্ট স্পিলের সাথে কথা বলি। উনি অফার লেটার সাথে সাথে পাঠিয়ে দেন। আমি এপ্রিলের ১ তারিখে জয়েন করার কথা জানিয়ে দেই।
ভিসা পেতে সমস্যা
অধ্যাপক লরেন্ট স্পিল আমাকে যে অফার লেটার দেন, তাতে লিখা ছিল এপ্রিল-জুলাই, ২০২৫ ফেলোশিপ প্রোগ্রামে আমি যাব। দিন গুনলে হয় ৯১ দিন। এ কারণে যিনি ভিসার কাগজ প্রসেসিং করে দিয়েছিলেন উনি লং স্টে ভিসা মানে ৬ মাস-১ বছরের ভিসার কাগজ জমা দেন। সরকারি পাসপোর্ট হওয়ায় আমাকে আগে থেকে দূতাবাসে ভাইভার ডেট নিতে হয় নাই। ফেব্রুয়ারিতে দূতাবাসে আমার কাগজ জমা দিতে গেলাম। আমার সরকারি পাসপোর্টে ৯০ দিনের বেশি ভিসা দেওয়ার নিয়ম নাই। অনেকক্ষণ ধরে আমার কাগজপত্র পরীক্ষা করে জানালো আমাকে জানাবে। ২ সপ্তাহ পর হঠাৎ করে ইমেইল পেলাম আবার নতুন করে শর্ট স্টে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। ই-মেইলে আমার সাথে অধ্যাপক লরেন্ট স্পিলকে কপি দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক স্পিল যোগাযোগে খুব ধীর গতির। আমি মনে মনে ভাবলাম, উনি ১ মাসের আগের ই-মেইলের উত্তর দিবেন না। কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে উনি ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে ফিরতি ই-মেইলে অফার লেটার পরিবর্তন করে দিলেন। আমি পরের দিনই আবার ভিসার জন্য আবেদন করলাম। ২ সপ্তাহ পর হাতে পেলাম সিনজেন ভিসা।
উচ্চ দামে টিকেট
আমি ২১ এপ্রিলে হাসপাতাল বিসেটে যোগদান করবো অধ্যাপকের সাথে, এমনটাই কথা ছিল। ভিসা পাওয়ার পর হাতে মাত্র ২ সপ্তাহ সময়। টিকিটের দাম আকাশ ছোঁয়া। ১ লাখ ২০ হাজার টাকার টিকিট আড়াই লাখ টাকায় কিনে উড়াল দেই। অনেকটা সময় পিছিয়ে গেছি। আর পিছিয়ে যেতে ইচ্ছুক নই।
শুরু হলো যাত্রা
২১ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টায় কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে প্যারিসের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। ১৪ ঘণ্টার যাত্রা করে যখন প্যারিসে পৌঁছি, তখন সন্ধ্যা ৯টা বাজে। বাইরে তখনো ঝলমলে রোদ। অবাক হলাম। ট্যাক্সি ভাড়া করে গেলাম বাংলাদেশি প্রবাসী আজাদ ভাইয়ের বাসায়। অসম্ভব ভালো মনের মানুষ তিনি। রাতের খাবার খেয়ে এশার নামাজের জন্য অপেক্ষা করি। সাড়ে ১১টায় এশার নামাজ পড়ে ঘুমাতে যাই। পরের দিন সকাল ৮টায় হাসপাতালে যেতে হবে।
বিসেট হাসপাতালে শুরু হলো কাজ
পরের দিন উঠে আজাদ ভাইয়ের বানানো পরোটা মজা করে খেয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেই। সাথে আছেন আজাদ ভাই। প্যারিসে কিছু চিনি না। উনি সাথে আছেন। ১ ঘণ্টা মেট্রোরেলে ভ্রমণ করে হাসপাতালে যাই। বিশাল বড় হাসপাতাল। প্রফেসর লরেন্ট স্পিলের মোবাইলে ফোন দিলে উনি ঠিকানা বলে দেন। দরজায় পৌঁছে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিল। প্রফেসর নিজে দরজা খুলে ভেতরে নিয়ে যান। ডিপার্টমেন্ট ঘুরে দেখান। অপারেশনের ক্যাথল্যাবে নিয়ে যান। উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপছিল। কত দিনের স্বপ্ন ধরা দিয়েছে আজ।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল/এমআই