সরকার জাতীয় মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা সাড়ে পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণ, অঞ্চলভিত্তিক হাব নির্মাণ এবং পর্যটন খাতকে অর্থনীতির চালিকাশক্তিতে রূপ দেওয়া। ২০২০ সালে গৃহীত এই মহাপরিকল্পনার অধীনে নতুন অবকাঠামো ও আন্তর্জাতিক মানের সেবা চালুর কথা থাকলেও তা এখনো নথিপত্রে সীমাবদ্ধ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় মহাপরিকল্পনার কাজ এখনো শেষ হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার এসে সেই মহাপরিকল্পনার খসড়াটি আবার পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই আলোকে খসড়াটি রিভিউ হচ্ছে। এরপর তা জাতীয় পর্যটন কাউন্সিলের (এনটিসি) অনুমোদনের জন্য যাবে। এর বাস্তবায়নে যত দেরি হবে, পর্যটন খাতে অব্যবস্থাপনা তত বাড়বে।
সাড়ে পাঁচ বছর আগে যেভাবে শুরু
বিটিবির তথ্য অনুযায়ী, দেশের পর্যটন খাতে ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান বা পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে বিদেশি পরামর্শক সংস্থা আইপিই গ্লোবাল। ২০১৯ সালে সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তি করা হলেও ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়। ২৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে মাস্টারপ্ল্যানের কাজটি শেষ করার কথা ছিল একই বছরের ৩০ জুন। তবে করোনার কারণে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় সময় বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। ২০২৩ সালের জুনে এসে শেষ হয় মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ। কিন্তু মহাপরিকল্পনা এনটিসিতে তা অনুমোদন হয়নি। অবশ্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজের প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ তুলেছিলেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। তবে খসড়া চূড়ান্ত ও স্টেকহোল্ডার কনসালটেশন হয়েছে বলে জানা গেছে।
সাড়ে ৫ মিলিয়ন পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য
মহাপরিকল্পনায় দেশজুড়ে এক হাজার ৪৯৮টি প্রাকৃতিক ও পর্যটন গন্তব্য চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে আকর্ষণীয় স্থান ভাগ করা হয়েছে ৫৩টি ক্লাস্টারে। উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে ১৯টি ক্লাস্টারে। মহাপরিকল্পনায় ২০৪১ সালের মধ্যে ৫.৫৭ মিলিয়ন বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই খাতে ২১.৯৪ মিলিয়ন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিকল্পনায় ১০টি পর্যটন ক্লাস্টার তৈরির জন্য ১.০৮ বিলিয়ন ডলার সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ চাওয়া হয়েছে।
বর্তমানে এর জন্য পাঁচটি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা চলছে। এ ছাড়া সরকার রাস্তা, বিদ্যুৎ ও নিরাপত্তার মতো অবকাঠামোগত সুবিধা উন্নয়নে ১০৫.৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা মূলত বিনিয়োগ করবে তারকা হোটেল, রিসোর্ট, বিনোদন পার্কসহ অন্যান্য বিলাসবহুল সুবিধা নির্মাণে। মহাপরিকল্পনায় পর্যটক আকর্ষণের জন্য হেলিপোর্ট নির্মাণ, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ, আবাসন সুবিধা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন রকমের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ, পাহাড়পুরের সোমপুর বিহার, সুন্দরবনের শরণখোলা এবং পদ্মা সেতুর পাশের মাওয়ায় মহাপরিকল্পনার আওতায় পাঁচটি পর্যটন উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হবে শিগগিরই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শাকের আহমেদ বলেন, ‘কোথা থেকে শুরু করেছি, বর্তমানে কোথায় আছি এবং কোথায় যাব, কিভাবে যাব- এসবের কোনো রোডম্যাপ নেই আমাদের। মহাপরিকল্পনার কথা আমরা অনেক দিন ধরে শুনতে পাই, কিন্তু আমরা এর কোনো প্রতিফলন দেখছি না। সরকারের পর্যটন বিষয়ক দুটি সংস্থা আছে পর্যটন করপোরেশন ও পর্যটন বোর্ড। কিন্তু সেখানে বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। তাদের আমলাতান্ত্রিক চক্করে আটকে গেছে মহাপরিকল্পনা।’
বাংলাদেশ ইনবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডি ইনবাউন্ড) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রেজাউল একরাম বলেন, ‘‘পর্যটন মহাপরিকল্পনা হবে আমাদের পর্যটন খাতের হাইওয়েতে গুগল ম্যাপের মতো। আমরা কোন দিকে যাব, কতক্ষণে, কিভাবে যাব, সেটা না জানার কারণে আমাদের এক ঘণ্টার যাত্রাপথে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে। পথটি না চেনার কারণে আমাদের মানুষকে জিজ্ঞাসা করে করে যেতে হচ্ছে। মাস্টারপ্ল্যানের নানা সভা-সেমিনার দেখলাম। কিন্তু আজও আমরা কিছু পেলাম না। ভালো হোক-মন্দ হোক, কিছু একটা দিক। পর্যটনে আমরা সুশৃঙ্খল যাত্রা শুরু করি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষতায় বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে; কিন্তু মহাপরিকল্পনা হচ্ছে না। আমাদের ডায়নামিক লোক থাকলে বলত, ‘আই ডোন্ট কেয়ার, আই উইল ডু ইট’।”
পর্যটন বিচিত্রার সম্পাদক ও পর্যটন করপোরেশন বোর্ডের পরিচালক মহিউদ্দিন হেলাল বলেন, ‘মাস্টারপ্ল্যান আলোর মুখ দেখেনি, এটা আমাদের ব্যর্থতা ও হতাশার জায়গা। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের নেতৃত্বে আমাদের পর্যটন খাতের একটি মহাপরিকল্পনা থাকার কথা ছিল। কিন্তু এটি না থাকার ফলে দেশের পর্যটন খাত অপরিকল্পিতভাবে বিকাশ হচ্ছে। মাস্টারপ্ল্যান থাকায় এই খাতের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে মিডিয়ার আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে ডেস্টিনেশন হিসেবে বহির্বিশ্বের ট্যুরিস্ট মার্কেটপ্লেসে পরিচিত করতে হবে। বিদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন মেলায় দেশের পক্ষ থেকে অর্থপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করা জরুরি হলেও সরকার তা বন্ধ রেখেছে। অথচ এটায় বারবার যাওয়া দরকার, প্রচার-প্রচারণা, বিদেশি দূতাবাসগুলোকে সিরিয়াসভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে, যাতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে, যেখানে আমেরিকান-ইউরোপিয়ান পর্যটক আসেন।’
কেন এই দেরি
পর্যটন মহাপরিকল্পনার কাজ শুরুর প্রথমদিকে প্রায় সব কমিটিতে সম্পৃক্ত ছিলেন বিটিবির গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য ও সেন্টার ফর ট্যুরিজম স্টাডিজ (সিটিএস) চেয়ারম্যান জামিউল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘মহাপরিকল্পনার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিদেশি কম্পানি আইপিই গ্লোবাল সঠিকভাবে কাজটি করেনি। তাদের কাজ দেখভালের জন্য গঠিত মনিটরিং কমিটিতে আমি ছিলাম। আইপিই গ্লোবালের সঙ্গে মনিটরিং কমিটির অনেক বাগবিতণ্ডা হয়েছিল। তাদের আমরা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি; কিন্তু তারা সেভাবে কাজ করেনি। যার জন্য সরকার মহাপরিকল্পনার কাজ শেষ হয়েছে ঘোষণা দিয়েও কাজটি পুরোপুরি বুঝে পায়নি। শেষ পর্যন্ত সরকার একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করে এবং আরো কয়েকটি বিষয়ভিত্তিক কমিটি করেছিল। ওই কমিটি বিষয়গুলোর মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন দিয়েছে। মহাপরিকল্পনার যেভাবে কাজ হওয়া দরকার, সেভাবে হয়নি-এটা কমিটির রিপোর্টেও উঠে এসেছে। কমিটি থেকে দুটি বিকল্প সমাধানের কথা বলা হয়। এর একটি যেটুকু ভুল হয়েছে, আইপিই গ্লোবালকে সেটুকু করে দিতে হবে। যদি তারা না করে তাহলে বাকি বিল দেওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে আমাদের দেশের যাঁরা বিশেষজ্ঞ আছেন, তাঁদের নিয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।’
বিদেশি পর্যটক আনার ক্ষেত্রে অনেক মৌলিক কাজ হয়নি বলে মনে করেন জামিউল আহমেদ। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে পর্যটন পণ্য নিয়ে প্রতিযোগিতা হচ্ছে। বিদেশ থেকে পর্যটক আনার ক্ষেত্রে আমাদের যেসব পর্যটন পণ্য আছে তা বিশ্ববাজারে নিয়ে যেতে হবে। তারপর না দেশে পর্যটক আসবে। আমাদের পণ্য চিহ্নিত করা নেই, এগুলোর কোনো উন্নয়ন নেই, বিপণনের জন্য বিটিবি রুটিন ওয়ার্ক করছে। দেশে পর্যটক নিয়ে আসার জন্য যদি সুযোগ-সুবিধা না করে দেওয়া হয়, তাহলে পর্যটন পণ্য কিভাবে আমরা বিক্রি করব। এ জন্য পর্যটন সহায়ক যেসব সুবিধা যেমন—যানবাহন, হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, বিনোদনসহ সব ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এসব কিছুই মানসম্মত হতে হবে এবং সেবার মূল্য সহনশীল মাত্রায় রাখতে হবে। যাতে একজন পর্যটক অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে সন্তুষ্ট হতে পারে বাংলাদেশ তুলনামূলক সাশ্রয়ীমূল্যে সুন্দর গন্তব্য। এসব কোনো কিছু না করে আমরা বড় বড় সভা-সেমিনার, মিটিং, কমিটি নিয়ে পড়ে আছি। ৫৪ বছর পরও পর্যটনের অনেক মৌলিক কাজই হয়নি।
ঘন ঘন নেতৃত্ব বদল
২০১৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত তিনজন সিইও দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিবারই নতুন নেতৃত্বে পরিকল্পনার গতি পাল্টেছে, ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। চলেছে ফাইল চালাচালি। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দাবি, দীর্ঘসূত্রতার মূল কারণ আমলাতান্ত্রিক জট, দায়িত্বের পরস্পরবিরোধিতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। তারা বলছেন, ‘পর্যটন হবে দ্বিতীয় রপ্তানি খাত’-এমন উচ্চারণ থাকলেও তার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট, জনবল বা রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল না। যত দিন না আমলাতান্ত্রিক জট ছাড়িয়ে বাস্তবায়নের স্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি হয়, তত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ পর্যটনে কেবল সম্ভাবনার দেশই থাকবে, বাস্তবায়নের নয়।
বিটিবি যা বলছে
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এটা আবার মাস্টারপ্ল্যান রিভিউ করছি। বর্তমানে এটি এডিটিংয়ের কাজ চলছে। আশা করছি এটি জুলাই মাসের মধ্যে শেষ হবে। তারপর এটি জাতীয় পর্যটন কাউন্সিলে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।’
সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ