সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দপ্তর থেকে মালপত্র অকশন বা নিলামে তোলা হয়ে থাকে। এসব পণ্যের মধ্যে আছে জমি, বাড়ি, বাইক, প্রাইভেট কার, বাস বা গাড়ি থেকে শুরু করে তেল, পিঁয়াজ, রসুনের মতো কাঁচা পণ্য। বাজারে প্রচলিত দামের তুলনায় সরকারি নিলামে কম মূল্যে এসব পণ্য কেনা যায়। অনেক পণ্যের প্রতি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ থাকে, যেমন—কাঁচা পণ্য, তেল, গার্মেন্টস আইটেম ইত্যাদি।
তবে সরকারি নিলাম হলে গাড়ি ও মোটরবাইক কেনার প্রতি সাধারণ ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি থাকে। সাধারণ ক্রেতারা নিজেরাই সরাসরি এসব পণ্য কেনার জন্য নিলামে অংশ নিতে পারেন। প্রশ্ন হলো, নিলামে কেনাবেচা করা কি ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ?
নিলাম কাকে বলে?
নিলামে কেনাবেচাকে আরবিতে ‘মুজায়াদাহ’ বলা হয়। আর উর্দু বা বাংলায় বলা হয় নিলাম। আল্লামা ইবনে জুজাই (রহ.) এ বিক্রয়কে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে : ‘পণ্যের দাম হাঁকাতে থাকবে এবং মানুষ একে অন্যের চেয়ে বেশি মূল্য বলতে থাকবে। এভাবে যে ব্যক্তি অন্যের চেয়ে বেশি মূল্য বলবে, সে পণ্য ক্রয় করবে।’
নিলামে কেনাবেচার বিধান
নিলামের মাধ্যমে কোনো কিছু বিক্রি করা শরিয়তে বৈধ। নিলামে যদি ধোঁকা, প্রতারণা বা অস্পষ্টতা না থাকে এবং বিক্রীত পণ্য যদি হারাম না হয়, তাহলে তা নিলামে ক্রয়-বিক্রয় করতে কোনো বাধা নেই। (ফাতহুল কাদির : ৬/৪৩৯; ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ : ১৪/২৮৭)
নবীযুগে নিলামে বিক্রির নমুনা
জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি তার মৃত্যুর পরে তার গোলাম আজাদ হবে বলে ঘোষণা দিল। তারপর সে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ল। নবী করিম (সা.) গোলামটিকে নিয়ে নেন এবং বলেন, কে একে আমার কাছ থেকে ক্রয় করবে? নুআঈম ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) (তাঁর কাছ থেকে) সেটি এত এত মূল্যে ক্রয় করলেন। তিনি গোলামটি তাকে সোপর্দ করে দিলেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২১৪১)
আতা (রহ.) বলেন, আমি সাহাবায়ে কেরামকে দেখেছি যে তাঁরা গনিমতের মাল বেশি মূল্য দানকারীর কাছে বিক্রি করাকে দোষ মনে করতেন না। (বুখারি সংশ্লিষ্ট অধ্যায়)
এ হাদিস থেকে খোদ নবী (সা.)-এর মাধ্যমে নিলামে বিক্রির নজির পাওয়া যায়। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ফকিহ নিলামে ক্রয়-বিক্রয়কে জায়েজ বলেছেন। এ ক্ষেত্রে আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসও গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। হাদিসটি হলো : রাসুল (সা.) একটি জিনপোষ ও পেয়ালা বিক্রয়ের জন্য পেশ করে বলেন—এই জিনপোষ ও পেয়ালাটি কে ক্রয় করবে? এ কথা শুনে এক ব্যক্তি বলল, আমি এক দিরহামে ক্রয় করছি। এ কথা শুনে রাসুল (সা.) বলেন, কে এক দিরহামের বেশি দেবে? তখন আরেকজন বলল, আমি দুই দিরহাম দেব। তখন তিনি তার কাছে সেটি দুই দিরহামে বিক্রয় করলেন। (তিরমিজি, হাদিস : ১২১৮)
নবীযুগে এক ভিক্ষুকের ঘটনা থেকেও নিলামের বৈধতা পাওয়া যায়। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার নবী (সা.)-এর কাছে এক আনসারী ব্যক্তি এসে ভিক্ষা চাইলে তিনি জিজ্ঞেস করেন—তোমার ঘরে কিছু আছে কি? সে বলল, একটি কম্বল আছে, যার কিছু অংশ আমরা পরিধান করি এবং কিছু অংশ বিছাই। একটি পাত্রও আছে, তাতে আমরা পানি পান করি। তিনি বলেন, সেগুলো আমার কাছে নিয়ে এসো, লোকটি তা নিয়ে এলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তা হাতে নিয়ে বলেন, এ দুটি বস্তু কে কিনবে? এক ব্যক্তি বলল, আমি এগুলো এক দিরহামে নেব। তিনি দুইবার অথবা তিনবার বলেন, কেউ কি এর বেশি মূল্য দেবে? আরেকজন বলল, আমি দুই দিরহামে নিতে পারি। তিনি ওই ব্যক্তিকে তা প্রদান করে দিরহাম দুটি নিলেন এবং ওই আনসারি সাহাবিকে তা প্রদান করে বলেন, এক দিরহামে খাবার কিনে পরিবার-পরিজনকে দাও এবং আরেক দিরহাম দিয়ে একটি কুঠার কিনে আমার কাছে নিয়ে এসো। লোকটি তা-ই করল। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে তাতে একটি হাতল লাগিলে দিয়ে বলেন, যাও, তুমি কাঠ কেটে এনে বিক্রি করো। ১৫ দিন যেন আমি আর তোমাকে না দেখি। লোকটি চলে গিয়ে কাঠ কেটে বিক্রি করতে লাগল। অতঃপর সে এলো, তখন তার কাছে ১০ দিরহাম ছিল। সে এর থেকে কিছু দিয়ে কাপড় এবং কিছু দিয়ে খাবার কিনল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ভিক্ষা করে বেড়ানোর চেয়ে এ কাজ তোমার জন্য বেশি উত্তম। কেননা ভিক্ষার কারণে কিয়ামতের দিন তোমার মুখমণ্ডলে একটি বিশ্রী কালো দাগ থাকত।
ভিক্ষা করা তিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারোর জন্য বৈধ নয়—(১) ধুলা-মলিন নিঃস্ব ভিক্ষুকের জন্য; (২) ঋণে জর্জরিত ব্যক্তি এবং (৩) যার ওপর রক্তপণ আছে, অথচ সে তা পরিশোধ করতে অক্ষম। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৬৪১)
নিলামে ইজাব কবুল
বিক্রেতা বা বিক্রেতার প্রতিনিধি যখন নিলামে দাম হাঁকাবে এবং উপস্থিত ক্রেতারা মূল্য বলতে থাকবে, তখন প্রস্তাবিত মূল্যের সঙ্গে বিক্রেতার সম্মতি ছাড়া বিক্রয় সম্পন্ন হবে না। এ বিষয় নিয়ে ফকিহদের মধ্যে কোনো মতানৈক্য নেই। এ ক্ষেত্রে যদিও পরিভাষায় মতানৈক্য আছে যে হানাফি মাজহাবের ফকিহদের মতে উপস্থিত ক্রেতা কর্তৃক প্রস্তাবিত মূল্য হলো ইজাব। বিক্রেতার পক্ষ থেকে সে মূল্যে সম্মত হওয়া হলো কবুল। তবে অন্য তিন মাজহাবে বিক্রেতার সম্মতি হলো বিলম্বিত ইজাব এবং ক্রেতা কর্তৃক প্রস্তাবিত মূল্য হলো অগ্রিম কবুল। মতনৈক্যের এ বিষয় শুধু পরিভাষাগত মতানৈক্য। (ফিকহুল বুয়ু, মুফতি তাকি উসমানি)
বিক্রেতার জন্য বেশি মূল্যের প্রস্তাব গ্রহণ করা কি আবশ্যক?
ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে বিক্রেতার জন্য বেশি মূল্যের প্রস্তাব গ্রহণ করা জরুরি নয়, বরং তার কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পেলে সে ক্ষেত্রে সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিলাম জারি রাখার অধিকার আছে। তা ছাড়া বেশি মূল্যের প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও বিক্রেতার জন্য কম মূল্যের প্রস্তাব গ্রহণ করা জায়েজ কি না? এ ব্যাপারে মালেকি মাজহাবের ফকিহরা এ পদ্ধতিকে জায়েজ বলেছেন। ইমাম ইবনে রুশদ (রহ.) বলেছেন, ‘নিলামে বিক্রয়কারী ক্রেতাদের যেকোনো একজনের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি করার ব্যাপারে স্বাধীন। যদিও অন্যরা তার চেয়ে বেশি মূল্য বলুক।’
হানাফি মাজহাবের কিতাবে এ ব্যাপারে আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে তাদের দৃষ্টিতেও বেশি মূল্যের প্রস্তাব থাকা সত্ত্বেও বিক্রেতার জন্য কম মূল্যের প্রস্তাব গ্রহণ করা জায়েজ আছে। (হাশিয়া দুসুকি, খণ্ড-৩, পৃষ্ঠা-৫)