১৫ জুলাই ২০২৪। এদিন থেকেই কোটাবিরোধী আন্দোলন মোড় নেয় নতুন দিকে। সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম আমি। চারদিকে ছাত্রদের প্রতিবাদ আর সমাবেশের মধ্যে অবস্থান করেছিলাম ছবির খোঁজে। কোটাবিরোধী ছাত্রদের কর্মসূচি আর ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে উত্তাল ক্যাম্পাস। বিকাল ৩টার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে খবর এলো বিজয় একাত্তর হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কয়েকজনকে মারধর ও আটকে রাখা হয়েছে। এ কথা জানার পরই আটক সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্ধারের জন্য হলের দিকে রওনা দেয় মিছিল নিয়ে। বিজয় একাত্তর হলের ভিতর থেকে শুরু হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ঢিল, ইটপাটকেল নিক্ষেপ। অন্যদিকে বাইরে থাকা আন্দোলনকারীরাও আক্রমণাত্মক অবস্থান নেন। একসময় পরস্পরমুখী সংঘর্ষ শুরু হলে হলের বিভিন্ন তলা থেকে লাঠিসোঁটা, কাঠ, দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র, রামদা, লোহার পাইপ ও বাঁশ সংগ্রহ করে বেঁধে নিচে নেমে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এরপর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ধাওয়া খেয়ে ভিসি চত্বরের সামনে চলে আসেন। সেখানে রাস্তার পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস পার্কিং করা ছিল। আক্রমণকারীদের হামলা থেকে রক্ষা পেতে কেউ কেউ বাসের ভিতর, কেউ আবার বাসের আড়ালে যাওয়া চেষ্টা করেন নিজেকে রক্ষা করতে। সাধারণ ছাত্র ও ছাত্রীদের চারপাশ থেকে ঘিরে রেখে পেটাতে শুরু করে। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সবাই মার খেতে থাকে বর্বরদের হাতে। এ পুরো ঘটনা ঘটেছে আমার চোখের সামনেই। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব আমি ভুলিনি। পালিয়ে না গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছবি তুলতে থাকি। হঠাৎ ক্যামেরার লেন্সের ভিতর দিয়ে আমার চোখ আটকে যায় একজন নারী শিক্ষার্থীর ওপর। দেখি, ঠিক তার চোখের নিচ অঝোরে রক্ত ঝরছে আর তাকে নিয়ে বুনো উল্লাসে আঘাত করে যাচ্ছে আক্রমণকারীরা। দেখেই মনে হচ্ছিল তার ভিতর এক প্রকার তীব্র ভয় কাজ করছিল। সঙ্গে সঙ্গে তার ছবি তুলতে থাকি। ওই সময় হামলাকারীরা আমাকে ছবি তুলতে নিষেধ করলেও আমি থামিনি। অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অফিসে ছবি পাঠাতেই অনলাইনে ওই নারী শিক্ষার্থীর ছবিটি প্রকাশিত হয়। এরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় ছবিটি। পরদিন দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয়; যা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ছাত্ররা সেদিনই ছবিটি প্ল্যাকার্ড বানিয়ে আন্দোলনের সফলতা ত্বরান্বিত করে। পরবর্তীতে ৩৬ জুলাইয়ের পর দেশজুড়ে দেয়ালে দেয়ালে ছবিটি পেইন্ট করা হয় এবং বিশ্বের বিভিন্ন এক্সিবিশনে প্রদর্শিত হয়।
লেখক : সিনিয়র ফটো সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রতিদিন