লাজুক স্বভাবের মাঝবয়সি এক ইংরেজ মহিলা ব্ল্যাকওয়েলের একটা বইয়ের দোকান থেকে বিষ সম্পর্কিত একটা বই কেনার পর অক্সফোর্ডে এসেছেন চা খেতে। মহিলার এক বন্ধু ওই সময়ের ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন- ‘আমরা যখন তার সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন তিনি মুচকি মুচকি হাসছিলেন। এবং আমাদের কথা শুনছিলেন। যখন আবার অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছিলাম তখনই তিনি হাতের বইটির মধ্যে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি নতুন কেনা বইটির মধ্যে বিষ সম্পর্কে নতুন কী তথ্য আছে তা জানার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব ছিলেন।’
দীর্ঘ আয়ুর জীবনে বিশ্ববিখ্যাত গোয়েন্দা উপন্যাস লেখিকা আগাথা ক্রিস্টি বিভিন্ন বিষয়ে জানার তীব্র আকাক্সক্ষার দ্বারা তাড়িত হয়েছেন এবং ওইসব বিষয়ে খুঁটিনাটি বিস্তারিত বিষয়ে জেনেছেন ও তার লিখিত উপন্যাসে আগাথা ক্রিস্টি আহরিত জ্ঞান খুনের তদন্ত কাজে ব্যবহার করেছেন। এ কারণে তাকে ‘দি ডাচেস অব ডেথ’ নামে অভিহিত করা হয়। এ ব্যাপারে তিনি দুটো বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
খুন ও খুন সম্পর্কিত রহস্য সৃষ্টিতে আগাথা ক্রিস্টির অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য তিনি জীবদ্দশায় বিশ্বের বেস্ট সেলিং উপন্যাস লেখিকায় পরিণত হন। তার ৮০ খানা গোয়েন্দা উপন্যাস ৫০ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে। নাটকের দিকে মন ফেরালেও এখানে অগাথা ক্রিস্টির নাম পাওয়া যাবে। রেকর্ড পরিমাণ সময় ধরে তার লেখা উপন্যাস নিয়ে নির্মিত নাটক লন্ডনের মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। তার এ উপন্যাসটির নাম ‘মাউস ট্রাপ’। এই নাটকটি ১৯৫২ সালের ২৫ নভেম্বর লন্ডনে মঞ্চায়ন শুরু হয় যা এখনো চলে। মাউস ট্রাপ ২৫টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে যা ৫০টিরও বেশি দেশে বিক্রি হয়েছে ও হচ্ছে। ওই নাটকের প্রযোজক স্যার পিটার সন্ডার্স ১৯৮৬ সালের ২৫ মার্চ এক শতাব্দীর এক-তৃতীয়াংশ কাল নাটক চলার সুবাদে এক বিরাট পার্টির আয়োজন করেছিলেন। ওই সময়কালে দি মাউস ট্রাপ ১৩ হাজার ৮৭০ বার অভিনীত হয়।
যদিও আগাথা ক্রিস্টি মারা গেছেন ১৯৭৬ সালের ১২ অক্টোবর। তবুও তার বইয়ের বিক্রি বেড়েই চলেছে এবং জনসাধারণও তার বিষয়ে ক্রমান্বয়ে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। এর অন্যতম কারণ হলো তার কাহিনির চলচ্চিত্র রূপায়ণ এবং টেলিভিশনে তার প্রায়শ প্রচার। আগাথা ক্রিস্টির স্বল্প পরিচিত কাহিনিগুলো নিয়ে ক্রিস্টি সিরিজ নির্মিত হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সিবিএস ‘মার্ডার উইথ মিরর’ উপন্যাসে মিস মার্পলের চরিত্রে হেলেন হেইনসের অভিনয় কাহিনিটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। আগাথার যেসব উপন্যাস চিত্রায়িত হয়েছে তার মধ্যে আছে মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস, অ্যান্ড দেন দেওয়ার ওয়াজ নান এবং ডেথ অন দি নাইল।
আগাথা ক্রিস্টির উপন্যাস এবং নাটক অবিস্মরণীয়। তিনি কী রকম মানুষ ছিলেন? তিনি কত বই লিখেছেন? আগাথা ৮০ বছর বয়সে ৮০তম বই লেখা শেষ করেন। জননন্দিত আগাথা সেই অনন্য ব্রিটিশ লেখিকা যার বই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পঠিত। এক জরিপে দেখা যায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাঠক আগাথা ক্রিস্টির বই পড়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে শেকসপিয়রের স্থান দ্বিতীয়।
আগাথার একটি মাত্র কন্যা রোজালিন্ড হিকস। আগাথা স্বভাবে লাজুক এবং একটি নিজস্ব জীবনযাপন তিনি ভালোবাসতেন। তিনি ভ্রমণ করতেও ভালোবাসতেন। সংগীতে তিনি আনন্দ পেতেন। ডেভনে ডার্ট নদীর তীরে অবস্থিত তার বাড়িতে পিয়ানো বাজাতে তিনি পছন্দ করতেন। আগাথা ভালো গাইতেনও। তার কণ্ঠ ছিল বেশ সুরেলা। রোজালিন্ডের সঙ্গে নিয়ে সাগরে সাঁতরাতে তিনি ভালোবাসতেন। অবসর সময়ে তিনি টেনিস ও ক্রিকেট খেলতেন। বাল্যকাল থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কিছু কিছু বিষয়ের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মূল্যবান বিশেষ ধরনের প্লেটে করে টাটকা পিচ ফল খেতে খুব পছন্দ করতেন। তার আত্মজীবনীতে ওই প্লেটের যে বিবরণ তিনি দিয়েছেন তা এ রকম-
‘প্রান্তদেশটা উজ্জ্বল সবুজ, তার ওপর দিয়ে সোনালি আঁক দেওয়া এবং প্রতিটা প্লেটের মাঝখানে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ফলের চিত্র-সব সময়ই আমার প্রিয় ফুল ডুমুর-বড় ধরনের লাল রঙের রসালো ডুমুর।’
আগাথা ক্রিস্টির একমাত্র নাতি ম্যাথু প্রিচার্ড। ম্যাথুর পিতা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এক রণক্ষেত্রে নিহত হন। ওই সময় ম্যাথুর বয়স মাত্র দুই বছর। ম্যাথু বলেছেন, তার নানি যে কোনো সফরকালীন সময়কে জাদুকরী রহস্যময়তায় পূর্ণ করে তুলতেন। তিনি ছিলেন রহস্যের রানি প্রতিদিন রাতে তিনি তার নতুন বইয়ের একটি করে পরিচ্ছেদ পড়ে শোনাতেন। তিনি আরও বলেছেন, ‘বিখ্যাত হওয়ার প্রতি তার ঘৃণাবোধ ছিল।’ আগাথার কাছে সত্যিকারের আনন্দময় কৌতুকের ব্যাপার ছিল তার নাতিকে ক্রিকেট খেলতে দেখা।
আগাথা ক্রিস্টির কাছে ম্যাথু ছিল : আমার স্মৃতিতে সেসব সময় এমন আনন্দময়। ছোট্ট বাচ্চা আনন্দে মাতিয়ে রাখার প্রতি তার ঝোঁক ছিল। এগুলো তিনি লিখেছিলেন ১৯৬৫ সালে। ম্যাথু বলেছেন, আমার নানি শিশুকালে যেমনটি ছিলেন, আমি ছিলাম ঠিক তেমনই। ১৯৭৪ সাল থেকে ম্যাথু আগাথা ক্রিস্টি লিমিটেডের চেয়ারম্যান। এই কোম্পানি আগাথা ক্রিস্টির সব বইয়ের স্বত্বাধিকারী। ম্যাথুর বয়স যখন মাত্র নয় বছর, তখন তার নানি দি মাউস ট্রাপ উপন্যাসের স্বত্বাধিকারী তাকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন।
আগাথা ক্রিস্টির শান্ত সমাহিত অভিব্যক্তির অভ্যন্তরে একটি বিক্ষুব্ধ ‘হৃদয়ের অস্তিত্ব বিরাজ করত। জীবন-অকস্মাৎ কীভাবে কুটিল আবর্তে পড়ে যেতে পারে সেই অভিজ্ঞতা আগাথার হয়েছিল। আমেরিকান পিতা ও ব্রিটিশ মায়ের ঘরে তার জন্ম হয় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯০ সালে। শৈশব জীবন সম্পর্কে আগাথা বলেছেন, একটি সুন্দর নার্সারিতে ‘খুব সুখের’ সময় কাটিয়েছেন তিনি। যেখানে ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল উদ্যান এবং স্নেহময়ী মাতৃতুল্য এক আয়া। ওই মহিলা তাকে পুসি বিড়াল সম্পর্কে বলতেন। তার জীবনে নিষ্ঠুর ঘটনাও ঘটেছিল। যাকে তিনি বন্দুকধারী মানুষ সম্পর্কিত স্বপ্ন বলে অভিহিত করেছেন। সেখানে একজন পরিচিত ও ভালোবাসার পাত্র কীভাবে শত্রুরূপী আগন্তুকেও পরিণত হতে পারে।
বাহ্যিকভাবে আগাথা একজন সত্যিকার ভিক্টোরিয়ান কুমারীরূপে বেড়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন আয়েশি, আত্মপ্রত্যয়ী এবং সুন্দরী। কিন্তু তার ভিতরে এমন একটা কল্পনাপ্রবণ মন গড়ে ওঠে, যেখানে যে কোনো সময়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সমগ্র বিশ্বে একটা আলোড়ন উপস্থিত হয় এবং তার শান্ত জীবনে অকস্মাৎ পরিবর্তন বহন করে আনে। ১৯১৪ সালে আগাথা আরচিবন্ড ক্রিস্টি নামে একজন তেজস্বী যুবককে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন রয়াল ফ্লাইং কোরের একজন ফ্লাইট কমান্ডার। যখন আরচিবন্ড ফ্রান্সের রণাঙ্গনে চলে যান, তখন আগাথা ভলান্টারি এইড ডিটাচমেন্টে যোগ দেন এবং তাকে টোকিওর একটি রেডক্রস হাসপাতালের কাজে নিয়োগ করা হয়। এ সময় আগাথা তার প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস শেষ করেন। বহু প্রকাশকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বডলি হেড অব লন্ডন নামে একটি প্রতিষ্ঠান ১৯২০ সালে ওই বইটি প্রকাশ করে। উপন্যাসটির নাম ‘দি মিস্ট্রিয়াস’।
এই গোয়েন্দা কাহিনিতেই আগাথা ইন্সপেক্টর হারকিউল ‘পয়রট’-এর সৃষ্টি করেন। পয়রট এমন একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হন যে, ১৯৭৫ সালে আগাথার ‘কার্টেন’ উপন্যাসে যখন তার মৃতু্যু হয় তখন নিউইয়র্ক টাইমস প্রথম পর্যায়ে পয়রটের মৃতু্যু সংবাদ প্রকাশ করে। দীর্ঘকাল ধরে পয়রট চরিত্রটি মঞ্চে ও চলচ্চিত্রে বহু বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতার প্রিয় চরিত্র ছিল। ওই চরিত্রে যারা অভিনয় করেন তাদের মধ্যে আছেন মঞ্চে চার্লস লটন এবং চলচ্চিত্রে টনি র্যানডল, আলবার্ট ফিনে ও পিটার উস্তিনভ।
আগাথার সৃষ্টির মধ্যে পয়রট চরিত্র শ্রেষ্ঠ এবং এক অনন্য আবিষ্কার। কিন্তু কোনো কোনো কাহিনিতে তিনি অন্য চরিত্রকেও প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশেষ করে চিরকুমারী মিস মার্পল। সেন্ট মেরি মিড গ্রামের অধিবাসীদের চরিত্র সম্পর্কে তার অন্তর্দৃষ্টি তাকে অনেক অপরাধ সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।
রহস্যময় অন্তর্ধান
প্রথম মহাযুদ্ধের পর আগাথা তার স্বামীর সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। ১৯১৯ সালে মেয়ে রোজালিন্ড জন্মগ্রহণ করে। তিনি তার স্বামী, কন্যা এবং লেখা নিয়েই সময় কাটাতে থাকেন। ১৯২৬ সালে ৩ ডিসেম্বর অকস্মাৎ আগাথা নিখোঁজ হয়ে যান। বার্কশায়ারের একটি রাস্তার ধারে তার গাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। সংবাদপত্রগুলো তার সন্ধানের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে। শত শত পুলিশ, সৈন্য এবং বেসামরিক নাগরিক তন্ন তন্ন করে সর্বত্র তার খোঁজ করে। কিন্তু না, তার কোনো হদিসই পাওয়া গেল না।
১১ দিন পর অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর ইয়র্কশায়ারের হ্যারোগেটের একটি হোটেলে সেখানকার বাদ্যযন্ত্রের দুজন বাদকের দৃষ্টি একজন মহিলার প্রতি আকৃষ্ট হলো। ডেইলি ‘মেইল’-এ ছাপা আগাথা ক্রিস্টির ছবির সঙ্গে চেহারার যেন মিল আছে। তারা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ কর্নেল ক্রিস্টিকে জানায়। সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল ক্রিস্টি হ্যারোগেট আসেন এবং শনাক্ত করেন তিনিই তার স্ত্রী আগাথা ক্রিস্টি। কর্নেল ক্রিস্টি সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি আমার স্ত্রী আগাথা। মনে হয় তার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। তিনি আমাকে চিনতে পারছেন না।’
অনেকে মনে করেন, এ ঘটনাটা তার বই বিক্রির জন্য একটা স্টান্ট বা কৌশল। অন্তর্ধানকালীন তার বই প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। কেউ কেউ ব্যাখ্যা দিলেন ভবিষ্যতে যে বই লিখবেন তার প্লটের ব্যাপার নিয়ে তিনি হয়তো পরীক্ষা করছিলেন।
কিন্তু সত্যকার ঘটনাটা ছিল সম্ভবত বেদনাদায়ক। সে জন্যই হয়তো তিনি এ ব্যাপারে বাকি জীবনে কখনো জনসমক্ষে আলোচনা করেননি। তার স্নেহময়ী মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আগাথা তার শুশ্রƒষা করতে থাকেন। কিন্তু তার মা যখন আকস্মিকভাবে মারা যান, তখন আগাথা তার পাশে ছিলেন না। এর অল্প কিছুদিন পর কর্নেল ক্রিস্টি তার স্ত্রীকে জানালেন যে, তিনি অন্য একজন মহিলার প্রেমে পড়েছেন এবং তিনি বিয়েবিচ্ছেদ চান। অন্য কথায় বলা যায়, আগাথার ভালোবাসার পাত্র হয়ে দাঁড়ালেন তার বিভীষিকার বন্দুকধারী ব্যক্তি। লাজুক, অতি কল্পনাপ্রবণ আগাথার এই উপস্থিতিতে স্মৃতি বিলুপ্ত হয়। আকস্মিকভাবেই তিনি তার স্বামীকে বা নিজেকে চিনতে পারার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন।
লেখকের দৃষ্টি
একজন বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসার পর আগাথা ক্রিস্টি পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং স্মৃতিশক্তি ফিরে পান। ১৯২৮ সালে তিনি ক্রিস্টিকে তালাক দেন। কিছু দিন পরেই মি. ক্রিস্টি বিয়ে করেন। আগাথা ওই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে সময় কাটান। ১৯৩০ সালে তিনি ইরাক সফরে যান এবং ম্যাক্স এডগার মালোয়ান নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হন। মি. মালোয়ান সুমেরিয়ান শহর ‘উর’ এর পুরাতাত্ত্বিক খনন কাজে সহায়তা করছিলেন।
ওই বছর সেপ্টেম্বরে আগাথা মালোয়ানকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে বহু বছর আগাথা তার স্বামীর সঙ্গে ইরাক ও সিরিয়ায় পুরাতাত্ত্বিক অভিযানে বেরিয়েছেন। এ সময়ে তিনি স্বামীর কাজে সহায়তা করতেন ও নিজের উপন্যাস লিখতেন। বিষ সম্পর্কে আগাথার পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত ‘দি পেল হর্স’ উপন্যাসে আগাথা হত্যাকাণ্ডে থেলিয়াম বিষ ব্যবহার করে। ১৪ বছর পরে একজন দক্ষিণ আমেরিকান মহিলা লেখেন, ওই গ্রন্থে আগাথা থেলিয়াম বিষের প্রতিক্রিয়ার এমন নিপুণ ও নির্ভুল বিবরণ দেন, ওই গ্রন্থ পাঠে তিনি ওই সবের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভালো জ্ঞান লাভ করেন। এক ব্যক্তিকে তার তরুণী স্ত্রী বিষ খাওয়ালে যেসব লক্ষণ ফুটে ওঠে, তা দেখে তিনি তৎক্ষণাৎ যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং ওই ব্যক্তির প্রাণ রক্ষা পায়। অন্য এক ঘটনায় বিষ প্রয়োগের ফলে এক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। কিন্তু একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ওই উপন্যাস পাঠের ফলে থেলিয়ামের প্রতিক্রিয়া ও লক্ষণ সম্পর্কে বিশেষ ধারণা লাভ করেন এবং সংঘটিত অপরাধের সমাধান করতে সক্ষম হন।
আগাথার বান্ধবী লেডি এলসা বাওকাষ আগাথা সম্পর্কে বলেছেন : তিনি বাথরুমের স্নানের টবের মধ্যে শুয়ে থেকে উপন্যাসের প্লট আবিষ্কার করতেন।
তার ব্যক্তিগত অভিমতও অনেক সময় তার উপন্যাসের মধ্যে পাওয়া যায়। ‘এ মার্ডার ইজ অ্যানাউন্সড’ কাহিনিতে খুনির ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে মিস মার্পল বলেছেন : ‘যেসব লোকের পৃথিবীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ আছে তারা সব সময় বিপজ্জনক। তারা মনে করে জীবন তাদের কাছে ঋণী। আপনার মধ্যে যা আছে তাই আপনাকে সুখী বা অসুখী করে থাকে।’
অসুখী সময় সম্পর্কে ক্রিস্টি লিখেছেন। আমি মনে করি, যে কারুরই উচিত স্বল্প সময়ের জন্য ওই সময়ের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা এবং বলা, হ্যাঁ ওই সময়টা আমার জীবনের অংশ এবং সেটা গত হয়ে গেছে। ওই সময়ের কথা আর ভাবার প্রয়োজন নেই। তিনি পক্ষান্তরে জীবনের সুখের ওপরই আলোকপাত করেছেন।
যখন তার বয়স ৭৫ বছর, তখন তিনি আত্মজীবনী লেখার ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তিনি লেখেন : ‘আমি এখন মৃতু্যুকে বরণ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। এখন আমার সঙ্গে আছেন আমার স্বামী, আমার কন্যা, আমার নাতি, আমার দয়ালু জামাই-এসব লোককে নিয়েই আমার জগৎ। আমি নিজেকে নিজেই উপভোগ করছি। যদিও প্রতিটি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার আনন্দের বিষয়ের তালিকা ছোট হয়ে আসছে। বেশিক্ষণ হাঁটা বন্ধ হয়ে গেছে। হায় সমুদ্র স্নান, মাংসের স্টিক, আপেল ও কাঁচা ব্ল্যাকবেরি। কিন্তু এখনো অনেক কিছু আছে। অপেরা ও কনসার্ট, বই পড়া এবং বিছানার মধ্যে শরীর এলিয়ে দেওয়া ও ঘুমান, এবং সব ধরনের স্বপ্ন...।’
স্মরণ করার কত বিষয়... রোজালিন্ডকে সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রে স্নান... ইংল্যান্ডের রানির সঙ্গে খেতে বসা। সুন্দর জীবনের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ এবং আমি যে ভালোবাসা পেয়েছি তার জন্যও ধন্যবাদ।
এর ১০ বছর পর ৮৫ বছর বয়সে আগাথা ক্রিস্টি লোকান্তরিত হন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান তার প্রিয় আত্মীয়স্বজন আর ইংরেজি সাহিত্যের দুই অবিস্মরণীয় অক্লান্ত ও দক্ষ গোয়েন্দা পয়রট, চতুর ও বাক্যবাগিশ মিস আরপল, ৮০টি গোয়েন্দা কাহিনি, অন্যান্য ৯টি বই এবং ৮টি মূল গোয়েন্দা মঞ্চ নাটক।