গাজায় যুদ্ধবিরতির পরও মানবিক বিপর্যয় থেমে নেই। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী যে পরিমাণ সহায়তা ঢোকার কথা ছিল, তার কিছুই পৌঁছাচ্ছে না ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে।
প্রতিদিন মাত্র ৯০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করছে। চুক্তিতে নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে এই সংখ্যা অনেক কম। এই ট্রাকগুলোর প্রায় ১৫ শতাংশই মানবিক সহায়তার ট্রাক। বাকিগুলো বাণিজ্যিক পণ্য বহন করছে। কিন্তু এসব বাণিজ্যিক চালানে মূলত কম পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারই বেশি থাকে। কারণ এমন পণ্য অনুমোদনের প্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজ।
বাহা জাকাউত পারক-এর বাহ্যিক সম্পর্ক পরিচালক। তিনি বলেন, আপনি প্যারাসিটামলও পাবেন না। সবচেয়ে সাধারণ ওষুধও এখন ফার্মেসি আর হাসপাতালে নেই। তিনি আরও জানান, হুইলচেয়ার, কৃত্রিম অঙ্গ (প্রস্থেটিক), ক্রাচসহ সব ধরনের সহায়ক যন্ত্র নিষিদ্ধ।
ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার ফলে গাজায় প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। গাজা সিটির এনজিও আতফালুনা সোসাইটি ফর ডেফ চিলড্রেন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত গাজায় ৫৮ হাজার মানুষ প্রতিবন্ধী জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যে অন্তত ২২ হাজার ৫০০ জন ইসরায়েলি আক্রমণে আহত হয়েছেন, যাদের অনেকেরই আজীবন পুনর্বাসন সেবা প্রয়োজন।
প্রতিবেদনটি আরও জানায়, ৮৩ শতাংশ প্রতিবন্ধী মানুষ স্থানচ্যুতির সময় তাদের সহায়ক যন্ত্র হারিয়েছেন। এছাড়া ৩৫ হাজার মানুষ সাময়িক বা স্থায়ী শ্রবণক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিতে আছেন।
আতফালুনার পরিচালক ফাদি আবেদ বলেন, গাজায় এখন সহায়ক যন্ত্রের চাহিদা ভয়াবহ পর্যায়ে। এই যন্ত্র না থাকায় অনেকে মানসিক স্বাস্থ্যসহ প্রয়োজনীয় সেবাও পাচ্ছেন না। তিনি জানান, আগে তাদের সংস্থা শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য ডায়াগনস্টিক ক্লিনিক চালাত, কিন্তু বর্তমানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় তা বন্ধ রয়েছে।
গাজায় চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোও হয়ে উঠেছে এক দুঃস্বপ্ন। ব্রিটিশ প্লাস্টিক সার্জন ড. ভিক্টোরিয়া রোজ ২০০৯ সাল থেকে গাজায় ট্রমা কেয়ারে সহায়তা দিয়ে আসছেন। সম্প্রতি একটি মেডিকেল টিমসহ গাজায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন এই চিকিৎসক। কিন্তু ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগেই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাদের গাজা প্রবেশ নিষিদ্ধ করে।
রোজ বলেন, আমাদের এত তাড়াতাড়ি নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো আগে কখনও হয়নি। মনে হলো তারা যুদ্ধবিরতির আগেই নিষেধদজ্ঞা দিতে চেয়েছিল। যাতে আমরা গাজায় ঢুকতে না পারি।
তিনি জানান, অক্টোবর ২০২৩ থেকে প্রতি মাসে মাত্র পাঁচজন স্বাস্থ্যকর্মীকে গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। এখনকার কনভয় সম্পূর্ণ ভরপুর, পরবর্তী দফায় আসন খোলার অপেক্ষায় তারা আছেন।
রোজ আরও জানান, লজিস্টিক অফিসার বা প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটরদের সহজে প্রবেশ অনুমতি দেওয়া হয় কিন্তু কারও নামের পাশে ডাক্তার বা সার্জন লেখা থাকলে তাকে আটকে দেওয়া হয়।
তার সহকর্মীরা যারা সেপ্টেম্বরে গাজায় গিয়েছিলেন, তারা জানান, পরিস্থিতি একটুও বদলায়নি। অর্থোপেডিক ও প্লাস্টিক সার্জন, ডাক্তার, নার্স সবকিছুর সংকটই চরমে।
রোজ আরও জানান, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার ফিলিস্তিনি চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন। এখনও ৯৫ জন ইসরায়েলের হেফাজতে আছেন।
তাই যুদ্ধবিরতি হলেও গাজার মানুষের জন্য শান্তি এখনো দূরের স্বপ্ন। ওষুধ, চিকিৎসা, খাদ্য; সবকিছুর অভাবে তারা বেঁচে আছেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত আর মানবিক সঙ্কটে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল