রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও থেমে নেই রাশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো। নানা প্রলোভনে তরুণদের রাশিয়া পাঠাতে সক্রিয় রিক্রুটিং এজেন্সির অবৈধ সিন্ডিকেট। দুবাই, সৌদি আরব, তুরস্ক হয়ে তারা বাংলাদেশি কর্মীদের রাশিয়ায় পাঠায়। এরপর ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে তাদের পাঠানো হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। গত কয়েক মাসে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছেন অন্তত অর্ধডজন বাংলাদেশি। এরপরও থামছে না রাশিয়াগামী কর্মীর সংখ্যা। জীবন-মৃত্যুর এই জুয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে আগ্রহীদের লাইন।
জানা গেছে, গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় গেছেন প্রায় ২ হাজার শ্রমিক। যে কয়টি রিক্রুটিং এজেন্সি রাশিয়ায় শ্রমিক পাঠায় তার মধ্যে অন্যতম ফেন্ডস অ্যান্ড কো-অপারেশন (এফসি) রিক্রুটমেন্ট। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, গত এক বছরে রাশিয়ায় যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে ৮০ শতাংশই তাদের মাধ্যমে
গেছেন। উত্তরার দিয়াবাড়ি গোলচত্বরের পাশেই তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, রাশিয়া গমনেচ্ছু শ্রমিকদের নির্মাণ কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই কয়েক শিফটে ৮০ থেকে ১২০ জন কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এসব কর্মীর প্রায় সবাই তরুণ। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কর্মীদের বয়সসীমা ২৩ থেকে ৩৮ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং বিভাগের এক কমকর্তা বলেন, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কর্মীদের রাশিয়ায় পাঠানোর জন্য নির্বাচন করা হয়। প্রশিক্ষণ, ভিসা প্রক্রিয়া, বিমান টিকিটসহ প্রত্যেক কর্মীর কাছ থেকে আমরা ৬ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। আমাদের সঙ্গে চীনের কয়েকটি কোম্পানির চুক্তি রয়েছে। কর্মীদের মান যাচাই করে তারা সরাসরি নিয়োগ দিয়ে থাকে। তারাই মূলত রাশিয়ার ভিসা প্রস্তুত করে দেয়। গত এক বছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় ২ হাজার শ্রমিক পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই এফসি রিক্রুটমেন্টের মাধ্যমে গেছে।
এদিকে রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর অনেক শ্রমিককে ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এফসি রিক্রুটমেন্ট-এর কর্মকর্তা মো. হাসান বলেন, অনেক কোম্পানি ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে রাশিয়ায় কর্মী পাঠান। সেখানে গিয়ে কাজ পেয়েও অনেকে বাধ্য হয়ে যুদ্ধের যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে একাধিক চীনা কোম্পানির সঙ্গে আমাদের চুক্তি থাকায় আমরা সরাসরি সেসব কোম্পানিতে শ্রমিক পাঠাই। রাশিয়ায় গিয়ে অনেকেই নানা প্রলোভনে পড়ে যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের মাধ্যমে যাওয়া অন্তত চারজন শ্রমিক কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে একজন নিহত হয়েছেন। বর্তমানে আমরা রাশিয়া পাঠানোর আগেই কর্মীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছি এবং ভিডিও ডকুমেন্ট রাখছি- যাতে তারা রাশিয়ায় গিয়ে যুদ্ধে না জড়ান। পাশাপাশি প্রায় ২০০ শতাধিক সন্দেহভাজন কর্মীকে দেশে ফেরত আনা হচ্ছে, যারা কর্মক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।
তবে রাশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিংহাভাগই নিজেদের বলে দাবি করলেও প্রতিষ্ঠানটির সরকারি অনুমোদন নেই। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো কর্তৃক অনুমোদিত বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকায় নেই এফসি রিক্রুটমেন্ট-এর নাম। এ ছাড়া তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এফসি সেন্টারেরও কোনো অনুমোদন নেই। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, অনুমোদন না থাকায় ভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে লোক পাঠানো হয়।
জানা গেছে, চলতি বছরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিয়ে অন্তত অর্ধডজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের গ্রামের আকরাম হোসেন, ময়মনসিংহের গৌরীপুরের ইয়াসিন মিয়া শেখ, নাটোরের সিংড়ার হুমায়ুন কবীর ও রাজবাড়ীর অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া রাশিয়া প্রবাসী অনেক বাংলাদেশি নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্বজনরা দাবি করেছেন।
এসব ব্যাপারে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বলছে, মস্কোর শপিং মলে সেলসম্যান, সিকিউরিটি গার্ড, রেস্টুরেন্টে শেফসহ বিভিন্ন পদে মোটা অঙ্কের বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণদের রাশিয়া নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দুই-তিন বছর চাকরি করার পর নাগরিকত্ব প্রদানসহ বাবা-মা, ভাই-বোনকেও রাশিয়ার নাগরিকত্ব প্রদানের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রলোভনে পড়ে শত শত বাংলাদেশি তরুণ-যুবক দুবাই, সৌদি আরব অথবা তুরস্ক হয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন রাশিয়ার রাজধানী মস্কো। এক-দুই সপ্তাহ পর তাদের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর বাইরে জনমানবহীন এলাকায় অবস্থিত রাশিয়ার সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। তাদের বলা হয়, যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে মাসে ৪ লাখ রুবল পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। প্রাপ্ত রুবল বাংলাদেশেও রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠাতে পারবে। প্রস্তাবে রাজি না হলে এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তাও বন্ধ। অগত্যা জীবনের মায়া ত্যাগ করে চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন তারা।
ভুক্তভোগী আকরামের বাবা মোরশেদ মিয়া বলেন, আমরা আত্মীয়দের কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা ধার করে আকরামকে রাশিয়ায় পাঠিয়েছিলাম। আকরাম একটি চীনা কোম্পানিতে ছয় মাস ধরে ওয়েল্ডার হিসেবে কাজ করছিল। চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে আকরামকে ‘চুক্তিবদ্ধ যোদ্ধা’ হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। ১৫ দিনের মৌলিক প্রশিক্ষণের পর আকরামকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়। গত ১৪ ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় সে নিহত হয়।
এদিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি তরুণদের ভিডিও। এসব ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তরুণরা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করছে; জঙ্গল বা ফাঁকা গম খেতের মধ্যে তারা বাংকার খনন করছে; রাস্তায় পড়ে আছে ট্যাংক, সাঁজোয়া যানবাহন, এপিসি, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানসহ যুদ্ধের শত শত সরঞ্জাম; আবার মেশিনগান থেকে শত্রুপক্ষের দিকে মুহুর্মুহু গুলি করা হচ্ছে; এখানে ওখানে পড়ে আছে ভূপাতিত ড্রোন। আবার অনেকেই ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে বিধ্বস্ত ভবনগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছেন।
এ বিষয়ে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে মানব পাচারের ঘটনা সংঘটিত হলেও যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এভাবে মানব পাচার আগে ঘটেনি। টাকার লোভে পড়েই মূলত মানুষ এ ফাঁদে পা দিচ্ছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ওপর পড়ছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো প্রচার কিংবা সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং সরকার রাশিয়ায় লোক পাঠানোর অনুমতি প্রদান করছে। এ মুহূর্তে সরকারের উচিত রাশিয়ায় যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া বন্ধ করা। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।