গল্প
সিডনির ক্লেমোর আকাশে সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে, যেন নিঃশব্দে আলো থেকে অন্ধকারে টেনে দেওয়া এক নরম পর্দা।
আলফ্রেসকোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসান চায়ের কাপে চুমুক দেয়। ধোঁয়া ওঠা চায়ের গন্ধে হঠাৎ করেই তার ভিতরে দুলে ওঠে এক পুরনো ঘ্রাণ-মাটি ভেজা, কাঁচা বাঁশের বেঞ্চ, আর টিফিন পিরিয়ডে কাক ডাকের মতো হইচই করা শৈশব।
কতদূর চলে এসেছে সে! মাইলের পর মাইল, বছর থেকে বছর-তবু শিবনাথ স্কুলের সেই টিনের চালা, বাঁশের ঘণ্টা, আর ধুলো-মাখা ভোরবেলা এখনো বুকের ভিতর নরম পায়ে হেঁটে বেড়ায়।
১৯৮৫ সালের সেই দিনগুলো আজও তার মনে জলছবির মতো স্পষ্ট।
স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত সে, পাশে থাকত তার বন্ধুরা-ইয়াসিন, শাতিল, দিলীপ, গফুর, সোহেল, মৃদুল, সেলিম, মনির, শামীম, লতিফ, মতিয়ার আর করুণা।
তারা একেকজন একেক রকম, কিন্তু একসঙ্গে ছিল এক একটি অনুপম কবিতা। তাদের মধ্যে কেউ বিখ্যাত নয়, কিন্তু তারা ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
প্রতিদিন পায়ে হেঁটে আসা-ধুলো মাখা স্যান্ডেল, রোদে পোড়া মুখ, আর হাতে বইয়ের ব্যাগ-তাদের ছেলেবেলার পরিচয়পত্র।
স্কুলে ঢোকার মুখে পুরনো ঘাসে শিশির, মাথার উপর জোছনার মতো আলো ঝরাতো শ্রাবণের মেঘ।
শিবনাথ স্কুল তখন আধুনিক ছিল না, কিন্তু সেখানে ছিল একরকম নির্ভরতা, ছিল একটানা ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস।
হাসানের চোখে ভেসে ওঠে সেই ক্লাসরুমের দৃশ্য-
আনোয়ার স্যারের বাংলা ক্লাসে প্রতিটি লাইন ছিল হৃদয়ের গহিন থেকে উঠে আসা।
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’-এই এক লাইনেই স্যার তার ছাত্রদের ভিতরে মানুষ গড়ে তুলতেন।
স্যারের চোখে চোখ রাখলে মনে হতো, ভাষার চেয়ে বেশি কিছু দিয়ে তিনি শিক্ষা দেন-স্নেহ, ধৈর্য, আর সম্মান।
পুষ্পেন্দু স্যারের অংকের ক্লাস ছিল বুদ্ধির খেলা, আবার আনন্দের উৎস।
তাদের ভুল উত্তর দেখে স্যার কখনো রেগে যেতেন না, বলতেন-
‘ভুল মানেই শিখতে থাকা, ঠিক করতে শিখলেই মানুষ হওয়া যায়।’
হাসান আজও তার জীবনের প্রতিটি ভুলকে সেই শিক্ষার চোখেই দেখে।
চঞ্চল নন্দীর ইংরেজি ক্লাস ছিল এক নাটকীয় বিস্ময়।
তিনি বলতেন- ‘Imagination is more important than knowledge.’
তখন অনেকেই বুঝত না, হাসান বুঝত-এটাই তো তার ভবিষ্যতের বীজ।
স্যারের উচ্চারণ, কথার ছন্দ, আর চোখে চোখ রেখে শেখানোর ভঙ্গি তাকে আজো তাড়িয়ে বেড়ায়।
টিফিন পিরিয়ড মানেই ছিল উল্লাসের মুহূর্ত।
শিঙাড়া, আইসক্রিম, বাদাম-যার যা ছিল, তা সবার জন্য। এক টুকরো পাউরুটি ভাগ করে খাওয়া ছিল এমন এক অভিজ্ঞতা, যা বড় হয়ে কত বড় দামে কেনার চেষ্টা করেও মেলে না।
মাঠের পাশে আম গাছের ছায়া, গ্যালারির নিচে বসে গল্প করা, আর মাঝে মাঝে স্যারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছোট্ট দুষ্টুমি-সব মিলিয়ে ছিল এক জীবন, যার নাম ছিল ‘ভালোবাসা’।
হঠাৎ ফোনে ভেসে আসে এক বার্তা-
সোহেল লিখেছে-
“লিপু, আজ স্কুলে গিয়েছিলাম। জানিস, জানালার নিচে এখনো আমাদের নাম খোদাই করা আছে। ভবনটা তিন তলা হয়েছে, কিন্তু সেই গন্ধটা এখনো আছে-চকের গন্ধ, ভেজা টিনের গন্ধ। দিলীপ এখন শিক্ষকতা করে, করুণা ব্যবসায়ী, লতিফ থানার অফিসার। সবাই ঠিক আছে, কেবল তুই নেই। ভাবলাম, যদি আবার সবাই একসাথে হই... যদি আবার ক্লাসে বসি, সেই বেঞ্চে-আনোয়ার স্যারের সামনে।”
হাসান চুপচাপ পড়ে, চোখ নামিয়ে রাখে চায়ের কাপে।
মনের ভিতরে হাহাকার উঠে আসে-একটা অতীতের আওয়াজ।
সে জানে, সে ফিরতে পারবে না। তবু স্মৃতির ভিতর হারিয়ে যেতে তো মানা নেই।
সে উত্তর দেয়-
‘তোরা সেই দিনগুলো এনে দিলি সামনে।
আমি এখনো সেই বেঞ্চে বসে আছি-অনুভবে।
রিইউনিয়নের প্ল্যান কর। আমি আসব।
কারণ আমরা একসাথে একটা জীবন গড়েছি,
আর সেই জীবনের নাম-বন্ধুত্ব।’
চোখের সামনে তখন ধীরে ধীরে ভেসে আসে সেই ক্লাসরুম-
চকের গন্ধ, চঞ্চল স্যারের উচ্চারণ, পুষ্পেন্দু স্যারের হাসি, আর আনোয়ার স্যারের চোখের ভাষা।
কিন্তু এখন আর কেউ বসে নেই সেই বেঞ্চে।
না হাসান, না সোহেল, না গফুর, না করুণা।
শুধু বাতাসে ঘুরে বেড়ায় কিছু মায়াময় আওয়াজ-
‘স্যার আসছে...’
‘আজ মাঠে খেলা হবে?’
‘টিফিনে আমার ভাগে সিঙ্গারা থাকবে তো?’
হাসান চোখ বন্ধ করে সব শুনতে পায়।
তার বুকের ভিতরে নীরব ঝড় ওঠে।
সে বুঝতে পারে-ছেলেবেলা ফুরিয়ে যায়,
তবু আমাদের ভেতরের শিশুটি হারায় না কখনো।
সে নিজের মনেই ফিসফিস করে বলে-
‘আমরা সবাই বড় হয়ে গেছি,
কিন্তু ভিতরটা এখনো সেই ছেলেটাই রয়ে গেছে,
যে প্রতিদিন বাংলা বইয়ের ভাঁজে শুকনো ফুল গুঁজে রাখত-
বন্ধুদের জন্য, ভালোবাসার জন্য।’
সিডনির ক্লেমোরে তখন গভীর রাত।
চারপাশে নিঃশব্দতা, কিন্তু হাসানের ভিতর ভেসে আসে শিবনাথ স্কুলের বাঁশের ঘণ্টার শব্দ।
টিনের চাল ধাক্কা খায় বাতাসে, আর এক টুকরো সময় ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে চোখের কোণে।
স্মৃতি শুধু ফিরে দেখা নয়-
স্মৃতি কখনো কখনো এক জীবন্ত প্রতিধ্বনি,
যা মানুষকে জানিয়ে দেয়,
সে কখনো একা ছিল না, একা নয়।
আর সত্যিকারের বন্ধুত্ব-
কখনো ফুরোয় না।