গল্প
নওগাঁ সার্কিট হাউসের ভিআইপি রুমে ঢুকে রবি সাহেবের মনে পড়ল- তখন এই বিল্ডিং এবং রুমগুলো এমন ছিল না। দামি শাটিনের পর্দা, শেডেড ল্যাম্পের আলোছায়া, দামি কার্পেট আর পরিপাটি বিছানার বদলে তখন ছিল আটপৌরে সুতির পর্দা, সাধারণ চাদরে ঢাকা বিছানা এবং আবরণহীন, আবরণহীন ষাট ওয়াটের ইলেকট্রিক বাল্ব। রবি তখন ভিআইপি রুমের সাজসজ্জা তদারকি করতেন। তিনি শাহবাগের ট্রেনিং শেষে এই মহকুমায় সদ্য প্রথম পোস্টিং পেয়েছেন। তরুণ বয়স, নবীন প্রাণ, চারদিকে যা দেখেন প্রবল ভালো লাগে। প্রকৃতি, নদী, আকাশ, গান, নতুন জায়গা, মানব এবং মানবী-সব কিছুতেই খুঁজে পান তরতাজা আনন্দ। ২৫ বছর পর আজ রবি নিজেই ভিআইপি। সবদিকেই পরিবর্তন হয়েছে। চেহারায় চিক্কণতা, ব্যক্তিত্বে গুরুগাম্ভীর্য, পদে অনেক উত্তুঙ্গ। সঙ্গে সুশ্রী, গৌরবর্ণা স্ত্রী। আবার সেদিনের সাবডিভিশন এখন হয়েছে জেলা শহর। তিনি তখন যেসব কাজের দায়িত্ব পালন করতেন তার অনেকগুলো এখন অন্যেরা তাঁর জন্য করছে। আজ শহরে ঢোকার সময় জেলার প্রধান কর্তা তাঁকে একদল পুলিশসহ অভ্যর্থনা করে এখানে নিয়ে এসেছেন। সিঁড়িতে উঠার পরই ইউনিফর্মধারী শাস্ত্রী-সেপাই দলের গার্ড অব অনারে তিনি বরিত হয়েছেন। প্রটোকল অফিসার জিজ্ঞেস করেছিল,
-স্যার, সন্ধ্যায় কী করবেন?
-রেস্ট নেব।
-ডিনারের আগে কিছু করবেন, কোথাও যাবেন?
একটু ভেবে তিনি বলেছিলেন, কোথায় যাওয়া যায়?
স্যার এনডিসি সাহেব আছেন। যদি কোথাও যাওয়ার কথা ভাবেন বলবেন।
-ঠিক আছে। কালকের প্রোগ্রামটা দেখি।
-স্যার, ম্যাডাম কোথাও যাবেন? যদিও এ শহরে শপিং বা দেখার মতো তেমন কিছু ...
-আচ্ছা লাগলে বলব।
আজমেরী বেগম কাপড় বদলাতে ভেতরে গেছেন। রবি সোফায় বসে জুতোর ফিতেতে হাত দিলেন। আজমেরীর ওখানে সময় লাগে। রবি জুতা, মোজা, ট্রাউজার এবং জ্যাকেট খুলে পাজামা-পাঞ্জাবি পরলেন। রবি পশ্চিম দিকের জানালার ভারী গোলাপি পর্দাটা টেনে বাইরে তাকালেন। বাইরে চাঁদ উঠেছে। আজ দুপুরে বৃষ্টি হয়েছিল। আবহাওয়া ঠান্ডার দিকে। ছোট্ট শহর। তিনি ভালো করে তাকালেন। পরিষ্কার দেখতে না পেলেও তাঁর মনে পড়ল সেই বাসাটা ছিল এদিকেই দক্ষিণ-পশ্চিমে। পাড়ার নামটা যেন কী ছিল? ‘দাশোরা।’ রাস্তার নাম? রুদ্রাক্ষ ঘোষাল রোড। আর বাসাটা? ’৪৭-এ পরিত্যক্ত সম্পত্তি। মহকুমা প্রশাসন পরে বরাদ্দ করেছিল সৈয়দ আবুল মোহসীন নামের এক ভদ্রলোককে। ইতিহাস আর রাজনীতির এক কাকতালীয় সন্ধি। এই বাসা থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে গিয়েছিল একটি পরিবার। আবার ওখান থেকে মোহসীন সাহেব তাঁর বাবা-মার হাত ধরে এখানে এসে ঠিক এই বাড়িটি পেয়েছিলেন। বাবা-মার পর মোহসীনের নিজের পরিবার হয়েছিল একদিন এবং ১৯৮৫ সালে একদিন ম্যাজিস্ট্রেট রবির সঙ্গে আদালতে একটি তরুণীর দেখা। এফিডেভিটের মামলা। উকিল, পিতা ও পুত্রীর সঙ্গে কথোপকথন। অনভিজ্ঞ, নিজের মূল্য সম্পর্কে অচেতন, চপল তরুণ মন। যে কোনো কিছুই ভালো লাগে।
লাল পর্দা, চারপাশে অসংখ্য অজ্ঞ লোকের ভক্তিভরা দৃষ্টি, নিজের হাতে দণ্ডবিধানের ক্ষমতা, বয়সে বড় আইনজীবীর ‘ইওর অনার’, পেশকার এর ‘স্যার’ সম্বোধন এবং সশস্ত্র পুলিশের অভিবাদনের কোনো কিছুই রবির কানে ঢুকছিল না সেদিন। মন, প্রাণ, চোখ, মস্তিষ্ক, কর্ণ সবকিছু প্রবল মনোযোগ দিয়ে দেখছিল একজন মাত্র মানুষকে। কাঠের বেড়ার মধ্যে দণ্ডায়মান তরুণীটিকে। এত আকর্ষণীয়া। আইনজীবীর কথায় তাঁর সম্বিত ফিরে এসেছিল।
-স্যার।
-বলুন?
-বয়স কমাতে চায় মেয়েটি।
-কেন?
-জন্ম তারিখ ভুল ছিল ভর্তির সময়। এই যে পিতার মুচলেকা আর ডাক্তারের প্রত্যয়নপত্র।
মুহূর্তে মঞ্জুরি আদেশ জারি হয়ে গিয়েছিল। এরপর শুধু ঘোর, আর ঘোর। স্কুলের কজনাই বা চেনে শহরে নতুন আসা তরুণ ম্যাজিস্ট্রেটকে। অতএব স্কুল ছুটির সময় রবি যে করেই হোক দরজায় উপস্থিত। একদিন, দুদিন, সাতদিন, দুমাস...। ভালো লাগা আর ভালোবাসার দুর্দান্ত বহ্নিগতি। মফস্বলী কানাঘুষা, তাতে কী? মহকুমা প্রশাসনে জড়িত মানুষ। কাজেই ফিসফাস এর বেশি এগোয়নি। তা ছাড়া বিষয় দ্বিপাক্ষিক। আপত্তি কার? চিন্তা একটি বিষয় নিয়ে। অপ্রাপ্তবয়স্কা। কবে আইএসসি পাস করবে? অপেক্ষা যে গুরুভার। তাও একদিন শেষ হলো। কিন্তু তারপরও। ঝড় এলো বৈশাখে ...
আজমেরীর হয়ে গেছে। তিনি ড্রেসিংরুমের কাজ সেরে রবির কাছে গেলেন।
-কী ভাবছ?
-বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম।
রবি সত্যও বললেন, মিথ্যেও বললেন। তিনি অতীতের কথাও ভাবছিলেন,
যা স্ত্রীকে কখনো বলেননি।
-ডিনারের আগে কি বাইরে যাবে আর?
-চল একটা পার্ক আছে। আমি যখন এখানে ছিলাম
তখনই ওটা করিয়েছিলাম।
এখনো জন বা যানদানব এ শহরকে আক্রান্ত করেনি। এখান থেকে সোজা একটা রাস্তা ধরে জায়গাটায় যাওয়া যায়। কিন্তু রবি ড্রাইভারকে বললেন একটু ঘুরো পথে যেতে। তিনি বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলেন। সিভিল সার্জনের অফিস, কৃষি শুমারির ছোট হলুদ বিল্ডিং। গাড়ি থামানো যায় না। স্ত্রী কিছু ভাবতে পারেন। তবুও এরই ফাঁকে রবি গলির প্রথম বাড়িটার দিকে চট্ করে তাকিয়ে নিলেন। ঠিকই দেখতে পেলেন জায়গাটা। নতুন বাসা আর দোকান তৈরি হওয়াতে যদিও সামনেটা ঢাকা পড়েছে। নিজেই বুঝতে পারলেন মানুষমাত্রেরই স্ববিরোধিতা আছে। একসময়, এখান থেকে, এসব থেকে রোদেলাদের উঠোন, উঠোনের বকুল গাছ আর হাস্নাহেনা থেকে দূরে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজ আবার ওসব দেখতে ইচ্ছে করছে। ওগুলো কেমন আছে, ওদের বাসায় কে আছে?
একটু পর ওরা পার্কে এসে ঢুকলেন। রবি মনে করার চেষ্টা করলেন অনেক বছর আগে এখানের কোন্ লোহার বেঞ্চিটাতে দুজনে দুদিক হলেও বসেছেন। চোখে, মুখে, মনে স্বপ্ন নিয়ে অনাগত দিনের কথা ভেবেছেন সোনালি স্বপ্নডানায় ভেসে ভেসে। রবি মনে করতে পারলেন বেঞ্চটার কথা। একটা শ্বেতপাথরে একজন পাঞ্জাবি সিএসপি এসডিওর নাম খোদাই করা ছিল। রবি আর রোদেলা সেই শ্বেতপাথরের সামনের বেঞ্চিটাই পছন্দ করতেন। একেবারে নিরিবিলি ঝোপঝাড়ের আড়ালে। দূর থেকে ছোট যমুনার ক্ষীণ স্রোত দেখা যেত।
রবিরা ওখানে বসলেন। এখানে আসতে চেয়েছিলেন। এখানেই বসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর আনন্দ লাগছে না। নিজেকে অপরাধী মনে হলো। ঠিক পূর্ণিমা না হলেও আজও শুক্লপক্ষের চাঁদ। এতক্ষণ নিওন সাইনের বাল্ব ছিল। লোডশেডিং আরম্ভ হওয়াতে এখন দেখলেন চাঁদের আলোয় জায়গাটা ভরে উঠেছে। বেঞ্চির পায়ের কাছে ঝরাফুলে ছাওয়া। আজমেরী বললেন, ‘কী ভাবছ?’
-এই যে এই সুন্দর জায়গাটার কথা। ঢাকায় তো এসব উঠে গেছে অনেক বছর হলো।
স্বামীর আন্তরিক কণ্ঠে স্ত্রী অন্য কিছু ভাবলেন না। বললেন, ‘হ্যাঁ ঠিক বলেছ। ভালো করেছ এ জায়গাটায় নিয়ে এসে।’
ঢাকায় এসব চোখে পড়ে না।
কিন্তু রবির এখন মনে হতে থাকল সেসব কথা। কী হয়েছিল রোদেলার? এই শহরেই ওরা আছে? পশ্চিম বাংলার যারা, তারা ‘খুঁজে’- ঘুরেফিরে নিজেদের মধ্যেই থাকতে চায়। অথচ খোঁজ নিতে ইচ্ছা হয়নি। সেই পার্বতীর মতো।
খাবারের সময় হয়ে গেলে ওরা উঠলেন।
পরদিন সকাল ১০টা। লাল, নীল, বেগুনি পতাকা আর বেলুন, ঝোলানো হয়েছে শামিয়ানার নিচে। ডিসি ফুটবল মাঠে সাদা চক দিয়ে মাঠের চারদিক চিহ্নিত করে চেয়ার আর সোফা পাতা হয়েছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য। কয়েক সারি চেয়ার সাধারণ অভ্যাগতদের জন্য। সভাপতি, প্রধান অতিথি, আসন গ্রহণ করলেন। একজন ঘোষিকার অনুষ্ঠান ঘোষণার ক্রম অনুসরণ শেষে প্রধান অতিথির ভাষণের পালা। ঘোষিকা বলল, “সরকারের মান্যবর সচিব রবিউল আলম চৌধুরী এবং আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথিকে নওগাঁ শিশু পুষ্টি প্রকল্প ‘সোনামণিদের জন্য’ সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান এবং প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করতে সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।’
তিনি মাইক্রোফোনের সামনে এসে বক্তব্য দেওয়া শুরু করলেন।
দর্শকের দ্বিতীয় সারিতে শহরের প্রধান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বসেছিলেন। তাঁর বয়স চল্লিশ পার হয়েছে। কিন্তু দেখতে প্রায় পঞ্চাশ মনে হয়।
এখন এই শ্রেণির যে কোনো নারী চুলে নানা রকম রং দেন। পারলারে গিয়ে অনুষ্ঠানে আসার আগে বিউটি স্লিপে কিছুক্ষণ মগ্ন থাকেন। নানারকম এজ ডিফাইং ক্রিম দেওয়ার ফলে তাদের মুখ ও হাতের চামড়া মসৃণ থাকে। এদের মধ্যে যারা জন্মগতভাবেই সুশ্রী হন, তাদের বয়স তাদের কারও কারও কন্যাদের থেকে কম মনে হয়। কিন্তু এই প্রধান শিক্ষিকা এসবের কিছুই করেননি। ফলে তাঁর চুল এ অপরাহ্ণের এবং মুখে চোখে স্নান সন্ধ্যার আঁচড় স্পষ্ট। এমন অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিতই দাওয়াত পান, তাই সব নিমন্ত্রণপত্রের খুঁটিনাটি পড়া হয়ে ওঠে না। তবে সঙ্গে আনতে হয়। মান্যবরের নাম ঘোষণার পর তিনি কার্ডটি ব্যাগ থেকে বের করে পড়লেন।
অনেক বছর আগের কথা। ও সবের ওপর ক্রমে ধুলো পড়ে গিয়েছিল, জমেছিল শ্যাওলা। বক্তাকে চিনতে পেরে এতদিন পর সেই ধুলো একটু একটু উড়া আর কীসের আঘাতে সবুজ শ্যাওলা ভেসে গিয়ে পাকা শানের কোণা উঁকি দেওয়া শুরু করেছিল। একটিমাত্র অনুভূতি দিয়ে তিনি সেগুলোকে স্বস্থানে ফিরিয়ে দেওয়া শুরু করলেন। সেটির নাম আত্মসম্মান। তিনি মনে মনে বললেন, ‘স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতার মতো শব্দপুঞ্জ তোমার মুখেই মানায়। বিশেষ করে পণরক্ষায় সর্বস্ব ত্যাগের সংকল্পের নিনাদও তোমাতেই শোভা পায়। ওই যে মঞ্চে তোমার পার্শ্ববর্তিনীকে দেখতে পাচ্ছি। একসময় দেখতে আমি ওর চেয়ে খারাপ ছিলাম না। কিন্তু শিকড়হীন উদ্বাস্তু পিতার কন্যা যে! ঢাকার প্রতিষ্ঠিত উচ্চপদাসীন যে কারও কন্যাই তো তোমার যোগ্য। এ কথা বুঝতে তোমার খুব সময় লাগেনি। বরং আমারই সময় লেগেছে অনেক মরুপথ পার হওয়ার পর। সেই ভয়াবহ আবিষ্কারের পরও জলভরা চোখে অপেক্ষা করেছি অবুঝ আমি। তবু ভালো, প্রতারণা করেছ কিন্তু করুণা করনি। তাতে আমার নারীত্বের আরও অবমাননা হতো।’
ঘোষিকা এবার অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে অভ্যাগতদের আপ্যায়নের আহ্বান জানালেন। প্রধান অতিথি এখন এদিকটায় আসছেন।
আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, কাউকে কিছু না বলে অনূঢ়া রোদেলা মোহসীন সভাস্থল ত্যাগ করলেন।