গাছের মগডালের সবুজ পাতার আড়ালে উঁকি দিচ্ছে শত শত সাদা-কালো বাহারি পাখি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় হেলিপ্যাডে যেন হেলিকপ্টার নামছে। পুরো গাছের শাখা-প্রশাখায় সাদা আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। বাতাসের দোলায় ডানার ঝাপটানি দিয়ে আকাশে পেজা তুলোর মেঘপুঞ্জের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে অসংখ্য পাখি। কেউবা বসে আছে ধ্যানে, কেউ বা বাচ্চাদের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, কেউ বা নিজেদের মধ্যে খুনশুটি করছে। কেউ বা আবার খাবার সন্ধানে উড়ছে আকাশজুড়ে। এ যেন অঘোষিত শামুকখোল পাখির অভয়ারণ্য।
এ অভয়ারণ্য বগুড়ার শাজাহানপুর, শিবগঞ্জ, শেরপুর, নন্দীগ্রাম, কাহালুসহ বিভিন্ন উপজেলায়। সুবিশাল কড়ই, শিমুল ও বটগাছগুলোতে ঝাঁকে ঝাঁকে শামুকখোল পাখি সংসার পেতেছে। তারা এখানে নিরাপদ প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করছে। এমন নিরাপদ প্রজননের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে দিন দিন বাড়ছে পাখির সংখ্যা। ভোরের আলো উঁকি দিতে খোলা আকাশে ডানা মেলে দেয় ঘুম ভাঙানিয়া পাখার ঝাপটানি। দিনের বার্তায় ঘুম ভাঙিয়ে দল বেঁধে চলে যায় খাদ্য আহরণে। গোধূলি বিকালে শোঁ-শোঁ শব্দের মিষ্টি কলতানে আবার ফেরে নীড়ে। এভাবে চলে তাদের সংসার। জানা গেছে, বিরল প্রজাতির শামুকখোল পাখি। সারস জাতীয় পাখি এটি। স্থানীয়দের কাছে শামুক ভাঙা, হাইতোলা মুখ এসব নামেও পরিচিত। খাল-বিলের ছোট ছোট শামুক-ঝিনুক, ছোট মাছ, আর ফসলের মাঠের পোকামাকড় খেয়ে জীবন বাঁচায় শামুকখোল পাখি। বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলায় ভদ্রাবতী নদী, নাগর নদী, শাহাজানপুর উপজেলার আড়িয়াবাজার নগর এলাকা, শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার ও নন্দীগ্রামসহ অন্যান্য উপজেলার খাল-বিল বা জমিতে দেখা মিলছে দৃষ্টিনন্দন শামুকখোল পাখির। ঝাঁক বেঁধে শামুকখোলের খাবার শিকার বা উড়ে চলা যেন প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার এলাকায় নদীতে ও মাঠের জমিতে ঝাঁকে ঝাঁকে শামুকখোল পাখি আহার করছে। তবে খাবার সংগ্রহ শেষ হলে বিশ্রামের জন্য উঁচু গাছে আশ্রয় নেয় শামুকখোল। গ্রামীণ জনপদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে এই পাখি। শামুকখোলের আনাগোনা শুরু হয়েছে প্রায় ৮ থেকে ১০ বছর ধরে। জায়গাগুলো যেন তাদের অভয়ারণ্য। তাদের পাখার ঝাপটা আর কোলাহলে আকাশ-বাতাস মাতিয়ে রাখে। সকালে সোনালি রোদ আর গোধূলির মৃদু আলোয় তাদের অবয়ব বাড়তি এক অপূর্ব সৌন্দর্যের অবতারণা ঘটায়। আশ্রয়স্থলের আশপাশে ঝাঁকে ঝাঁকে ওড়াউড়ি করে যেন ডানায় ডানায় ভোরের আলো ফোটায় ও গোধূলির আভায় সন্ধ্যা নামায়। এ দৃশ্য অমলিন।
দিনশেষে তাদের নীড়ে ফেরার দৃশ্য তাক লাগায়। মনে হয় হেলিপ্যাডে নামছে হেলিকপ্টার। বাংলাদেশে বড় পাখিদের একটি শামুকখোল। ধূসর সাদা শামুকখোলের লেজ ও পাখার শেষ অংশ কালো রঙের। পাখিটি ৮১ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য এবং এর পাখার দৈর্ঘ্য হয় ৪৪ সেন্টিমিটার। শামুকখোলের দেহের সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ঠোঁট। প্রায় ১৪ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য দুই ঠোঁটের মাঝে ফাঁকা থাকে। শামুকখোল সব সময় দল বেঁধে চলে। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার শিক্ষাবিদ রবিউল ইসলাম রবি জানান, বিহার এলাকায় শামুকখোল পাখির অবাধ বিচরণ। এখানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গাছের মগডালে তারা সংসার পেতেছে। পাখিদের অতি যত্ন দিয়ে আগলে রেখেছেন গ্রামবাসী। এই গ্রামে কোনো পাখি শিকারিকে আসতে দেওয়া হয় না। ফলে নিরাপদে বসবাস করছে পাখিগুলো। বগুড়া সামাজিক বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার, নন্দীগ্রাম উপজেলার থালতা মাজগ্রাম ইউনিয়ন, শাজাহানপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়ন, শেরপুর উপজেলার গাড়ীদহ, শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার গ্রামে অসংখ্য শামুকখোল পাখি বাসা বেঁধেছে। গ্রামের চারপাশে রয়েছে একাধিক বড় বড় গাছসহ বাঁশবাগান। এসব গাছের চিকন মোটা ডালগুলোয় আবাসস্থল গড়ে তুলেছে শামুকখোল। এই পাখিগুলো আবার চলেও যায়। কিছুদিন পর আবার চলে আসে।