গত ১৫ বছরে শাজাহান খান তার নির্বাচনি এলাকা মাদারীপুরে বানিয়েছিলেন প্যারালাল আওয়ামী লীগ। এলাকাবাসী বলতেন, ‘খান লীগ’। ‘খান লীগের’ অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল মাদারীপুরবাসী। শুধু তার নির্বাচনি এলাকা নয়, মাদারীপুরে শাজাহান খান, তার পরিবার এবং ক্যাডার বাহিনী সৃষ্টি করেছিল ত্রাসের রাজত্ব। শ্রমিক নেতা হিসেবে পরিচিত শাজাহান খান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়ে যান পেশিশক্তি এবং মাস্তানির জোরে। মাদারীপুরে ‘খান-লীগ’ এর দাপটে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও অতিষ্ঠ ছিলেন। ভাই ও স্বজনদের মাধ্যমে জেলার প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছিল তাঁর একক আধিপত্য। জমি দখল, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। শাজাহান খান মাদারীপুর-২ (সদর-রাজৈর) আসনের সাবেক এমপি। মাদারীপুরে তাঁর বিকল্প কেউ নেই বলে মনে করত তাঁর পরিবার। খান পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে সদর ও রাজৈরে কোনো কাজ হতো না। শাজাহান খানের পুরো সিন্ডিকেট (চক্র) নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরই চাচাতো ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দুই বারের উপজেলা চেয়ারম্যান পাভেলুর রহমান খান। তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর ছোট ভাই ওবায়দুর রহমান খানকে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানান শাজাহান খান। ওবায়দুর আইনজীবী সমিতির সভাপতি হওয়ায় আদালতপাড়ায় ছিল তাঁর আধিপত্য। কেউ শাজাহান খানের বিরুদ্ধে গেলেই মামলার আসামি বানিয়ে হয়রানি করা হতো। শাজাহান খানের আরেক ভাই হাফিজুর রহমান খান। তিনি মাদারীপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি। সবার কাছে ‘নানা’ হিসেবে পরিচিত হাফিজুর জেলার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কার্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশনের প্রধান। জেলার ৮০ ভাগ উন্নয়নকাজ ওই প্রতিষ্ঠান পেত। অন্য ঠিকাদারদের কাছে কমিশনের মাধ্যমে কাজ বিক্রি করে দিতেন তিনি। পাসপোর্ট কার্যালয়, বিআরটিএ, সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, থানাসহ বেশ কয়েকটি কার্যালয়ে হাফিজুরের একক আধিপত্য ছিল। ওই কার্যালয়গুলোতে হাফিজুরের নিয়োগ করা লোকজনকে কমিশন না দিলে ফাইল নড়ত না।
শাজাহান খানের চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান খান বলেন, ‘আমি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন রাজনীতি করলেও তাঁর সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। শাজাহান খান যখন মন্ত্রী, তখন তাঁর সুপারিশ ছাড়া জেলায় কিছুই হতো না। স্থানীয় সরকারি চাকরিতেও তাঁর হস্তক্ষেপ ছিল।’ তিনি বলেন, শাজাহান খানের দ্বারা আওয়ামী লীগের লোকজন উপকৃত হয়নি। গত ১৫ বছরে তিনি ভাই, ছেলে ও আত্মীয়স্বজন দিয়ে সিন্ডিকেট করে সব নিয়ন্ত্রণ করতেন। উপজেলা নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজের ছেলেকে চেয়ারম্যান পদে ভোট করান এবং জয়ী করেন শাজাহান খান। পরে ছেলেকে মাদারীপুর জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতিও করেন প্রভাব খাটিয়ে। মাদারীপুরের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, পৌরসভাসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের উন্নয়ন প্রকল্পের কে কোন কাজ পাবেন, তা ঠিক করে দিতেন শাজাহান খানের ভাই হাফিজুর রহমান খান। তাঁকে প্রকল্পের মোট বরাদ্দের ১০ থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হতো।
এলজিইডির ঠিকাদার মুরাদ হোসেন বলেন, সড়ক বিভাগ থেকে দরপত্র হলেই তিনি (হাফিজুর) কাউকে কাজ দিতেন না। নিজে কাজ নিয়ে আরও পাঁচজনকে অংশীদার রাখতেন। ওই দরপত্র থেকেই গত পাঁচ বছরে তাঁর আয় হয়েছে অন্তত ৫০ কোটি টাকা। এভাবেই গোটা মাদারীপুরে ত্রাসে রাজত্ব কায়েম করেছিলেন অপরাধের ‘কিং খান’-শাজাহান খান।