ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের জয় এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পরাজয়ের ঘটনায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নেতারা বিস্মিত ও হতভম্ব।
কর্মী-সমর্থকরাও ভাবছেন বিষয়টি নিয়ে। হঠাৎ বিশাল ব্যবধানের এমন পরাজয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না তারা। বুঝতে পারছেন না কোথা থেকে কীভাবে কী হয়ে গেল? নানান হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন তারা। কেউ কেউ জাতীয় নির্বাচনের কথা চিন্তা করে কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। আবার কেউবা বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে বেশির ভাগই মনে করছেন এ ছাত্র সংসদ নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
ডাকসুর ফলাফল জাতীয় রাজনীতিতে কোনো প্রভাব রাখবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ডাকসুতে ভিপি-জিএস হয়েছেন- এমন অনেক নেতা জাতীয় রাজনীতিতে আছেন, কেউবা হারিয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে যারা বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠনভুক্ত ছিলেন, তাদের কেউ কেউ জাতীয় সংসদে এসেছেন। বাকিরা এখন পর্যন্ত লড়াই করছেন, সংগ্রাম করছেন আসার জন্য।
এ ক্ষেত্রে কারও নাম নিয়ে বলাটা ঠিক হবে না, আমি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেছেন, ডাকসু নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দোসরদের সঙ্গে মিলে আরেকটি রাজনৈতিক দল কীভাবে খেলাটা খেলল। এগুলো সবাইকে বুঝতে হবে, জানতে হবে এবং এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, ছাত্রদলকে পরাজিত করতে শিবিরের সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক জারি রেখেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ।
তিনি বলেন, যেহেতু ছাত্রলীগ এখন নিষিদ্ধ এবং ছাত্রলীগের সঙ্গে তাদের অনেকেই মিলেমিশে ছিল, এটা একটা সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনি বলেন, ঢাকা ডাকসু নির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের সবাই শিবিরকে ভোট দিয়েছে। বিএনপিকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে আওয়ামী লীগ এখন শিবিরকে সাপোর্ট দিচ্ছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, মঙ্গলবার ডাকসু নির্বাচনে স্বৈরাচার আর রাজাকার একাকার হয়ে গেছে। গভীর ষড়যন্ত্র প্রতিফলিত হয়েছে ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তাবিরোধীরা আজকে বিজয়ী হয়েছে। এটা বিজয় নয়, ছাত্র-জনতার বিজয় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সেই ষড়যন্ত্র আমরা আগেই অনুমান করেছিলাম। কিন্তু ধরতে পারিনি। নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি, এটা আমাদের সীমাবদ্ধতা, এটা বাস্তবতা।
দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, এ ধাক্কা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চান। বিএনপি মনে করে, এতদিনে তারা রাজনৈতিক শত্রু নির্ধারণ করতে পেরেছে, এখন শত্রুকে টার্গেট করে পরিকল্পনা গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনা তাদের জন্য সহজ হবে। বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে তারা জামায়াতে ইসলামীকে কীভাবে মোকাবিলা করবে তা নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা করছেন।
জানা যায়, বিএনপির ভিতরে একটি প্রস্তাব ছিল যে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্যানেল দেওয়া। সবার সমন্বয়ে ৩১ দফার মতো প্যানেল দেওয়া। দলটির কেউ কেউ বলছেন, ওই প্যানেল দিলে এরকম ফল হতো না। বিএনপির ৩১ দফায় উল্লেখ ছিল যে, সবাইকে নিয়ে দেশ গঠন। এটা তারা ভুল করেছে কি না? দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে ভুল হয়েছে কি না? তৃতীয়ত, এখন তারা দেখতে পাচ্ছে যে, শুধু ক্যাম্পাসে ভোট প্রার্থনাই করেছে ছাত্রদল। কিন্তু শিবির তাদের জয়লাভের জন্য নানা রকমের কলাকৌশল ও পরিকল্পনা নিয়েছে আরও অনেক আগে থেকে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, গত ১৫ বছর ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ঢুকতেই পারেনি। মধুর ক্যান্টিনেও চালাতে পারেনি সংগঠনের কার্যক্রম। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর মধুর ক্যান্টিনে প্রবেশ করেছিল ছাত্রদল। সেই সময়ে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলসহ নেতা-কর্মীদের ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে বের করে দেয়। এরপর ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা মধুর ক্যান্টিনে আর ঢুকতে পারেননি। এজন্য সংগঠনও বিস্তার লাভ করতে পারেনি। কিন্তু শিবির ছদ্মবরণ ও নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে ছাত্রলীগের ভিতরে ঢুকে তাদের সঙ্গে কাজ করেছে। এ ছাড়া রাজধানীতে শিবির সমর্থক বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টারও রয়েছে। এ কোচিং সেন্টারে গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের কম খরচে পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছে। এ সুযোগে তাদের মোটিভেশনও করা হয়েছে। এরপর তারা যখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়, তখন গণরুমে থাকাসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করেছে। এ ছাড়া ঢাবির ডিবেটিং ক্লাবসহ অনেক কিছুর নেতৃত্ব দিয়েছে।
এভাবে তারা শিবিরমুখী একটা সমর্থন গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে। এ গোষ্ঠীর কেউ কেউ ছাত্রলীগের মধ্যে ঢুকে নিজেদের ক্ষমতার শক্তি সংহত করেছে। কিন্তু ছাত্রদল এ মেকানিজমের কিছুই করেনি এবং এই মেকানিজম সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাও ছিল না, কিছু জানেও না। ছাত্রদল মনে করেছে অভ্যুত্থানের ফসল তারা এমনিই পাবে। তারা সংগঠনভিত্তিক এবং দলীয়ভিত্তিক প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু শিবির খুব সিরিয়াসলি নানা মাত্রায় কাজ করেছে। ছাত্রলীগ বিগত সাড়ে ১৫ বছর ক্যাম্পাসে হামলা, গণরুমে নিয়ে অত্যাচার, বাধ্যতামূলক মিছিল নিয়ে যাওয়া- এসব বিষয়ে শিবির শিক্ষার্থীদের সচেতন করেছে।
তা ছাড়া ৫ আগস্টের পর সারা দেশে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে দখল এবং চাঁদাবাজির পরিকল্পিত অপপ্রচার সামাজিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় সেটারও একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ক্ষমতায় এলে ছাত্রদল ছাত্রলীগের মতো করবে, এমন অপ-প্রচারণাও ছিল ব্যাপকভিত্তিতে।
এদিকে, জামায়াত নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ মঙ্গলবার রাত ১২টায় সামাজিক গণমাধ্যমে শিবিরের বিজয়ে তিনবার করে ‘আলহামদুল্লিাহ’ বলে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। অথচ এ ডাকসু নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টা পর ভোর ৫টার পরে। এ ছাড়া নির্বাচনের ভোট গণনা ও ফল নিয়ে নানা রকমের ষড়যন্ত্রের গুরুতর অভিযোগ উঠলেও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বিএনপির এই ধৈর্য ধরে থাকাটাও দেশের ভিতরে একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছে। এতকিছুর পরও ছাত্রদল নিশ্চুপ ছিল। কোনো ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষে জড়ায়নি। বিশেষ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি সংঘাতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ছাত্রদলকে ইতিবাচক রাজনীতি করার নির্দেশ দেন। অনেকের মতে, ছাত্রদল এত বড় সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও তারা যে ধৈর্য ধরেছেন এটা তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলেও মনে করছেন অনেকে। তবে সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় সমর্থক শিক্ষকদের ভিসি নিয়োগের মতো জাতীয় নির্বাচনের আগে সারা দেশের জেলা প্রশাসক এবং ইউএনও পদে নিজেদের মতাদর্শের ব্যক্তিদের বসানোর চেষ্টা করছে জামায়াতে ইসলামী- এসব বিষয়সহ প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পুরো কমিশনের প্রতি বিএনপির হাইকমান্ডকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি। যাতে করে ডাকসুর মতো জাতীয় নির্বাচনেও কোনো ধরনের ছলচাতুরি কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জনতার বিজয় ছিনিয়ে নিতে না পারে জামায়াত-শিবির।
বিডি প্রতিদিন/নাজিম