কাতারে ইসরায়েলের বিমান হামলায় আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে উঠেছে গুরুতর প্রশ্ন। এক কথায় বলা যায়, ৪০ কোটি ডলারের বিলাসবহুল উপহার পেয়েও কাতারকে 'বিশ্বাসঘাতকতা' করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
৯ই সেপ্টেম্বর, কাতারের রাজধানী দোহায় আকস্মিকভাবে বোমা হামলা চালায় ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। এই হামলার খবর আগে থেকেই জানা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। কিন্তু তারপরেও যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশ কাতারকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। ফলে আরব বিশ্বে আমেরিকার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠে গেছে।
ফিলিস্তিনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে চিরতরে নির্মূল করতে মরিয়া ইসরায়েল এবার কাতারকে নিশানা করেছে। দোহাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বোমাবর্ষণ করেছে তেল আবিবের বিমানবাহিনী। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, দীর্ঘদিন ধরে কাতারের নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাহলে কি ইসরায়েলকে সুবিধা করে দিতেই দোহাকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে ওয়াশিংটন?
ইসরায়েলি বিমান হামলার পরপরই তেল আবিভ বিবৃতি দিয়ে জানায়, হামলার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আগেই অবহিত করা হয়েছিল এবং তার 'আশীর্বাদ' পাওয়ার পরেই এই অভিযান চালানো হয়। এমনকি, এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অত্যাধুনিক 'এফ-৩৫ লাইটনিং টু' যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করা হয়েছে।
হামলা প্রসঙ্গে ট্রাম্পের মন্তব্য ছিল খুবই নির্লিপ্ত। তিনি বলেন, “এটা ঠিক যে ইসরায়েল আগেই আমাদের সতর্ক করেছিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল, ফলে আক্রমণ আটকানো যায়নি।”
তবে দোহার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’র দাবি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের মতে, ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি, কারণ তিনি চান যে ইরান সমর্থিত হামাস নেতাদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করুক ইসরায়েল।
গত মে মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম বিদেশ সফরে ট্রাম্প কাতারকে বেছে নিয়েছিলেন। সেই সফরে দোহা তাকে ৪০ কোটি ডলারের একটি বিলাসবহুল বোয়িং ‘৭৪৭-৮’ বিমান উপহার দেয়, যা পরিচিত ‘উড়ন্ত প্রাসাদ’ নামে। বিনিময়ে, কাতার আমেরিকার কাছে নিরাপত্তার আশ্বাস চেয়েছিল। কিন্তু বর্তমান ঘটনা প্রমাণ করে সেই আশ্বাস ফলপ্রসূ হয়নি।
কাতার প্রশাসনের ভেতরে প্রশ্ন উঠেছে আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ছাউনির প্রয়োজনীয়তা নিয়েই। যেখানে আমেরিকার প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলি হামলা বিনা বাধায় সম্পন্ন হয়, সেখানে এই ঘাঁটির অস্তিত্ব কতটা অর্থপূর্ণ?
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, জুনে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় কাতারকে বাঁচাতে মার্কিন বাহিনী তৎপর ছিল না বরং তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ধ্বংস করতে তারা বিন্দুমাত্র দেরি করেনি। কিন্তু এবার, হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বকে নির্মূল করার জন্য ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েই হামলা চালায়। তাই মার্কিন সৈন্যদের ‘শীত ঘুম’-কে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে কাতারকে শান্ত করতে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন ট্রাম্প। তিনি নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ পোস্ট করে বলেছেন, হামলার সিদ্ধান্ত তার নয় এবং ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি পুরোটাই লোক দেখানো।
কাতারে এই হামলার ঘটনায় আরব দেশগুলোর মধ্যে অভূতপূর্ব ঐক্য দেখা গেছে। ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং তুরস্ক একযোগে ইসরায়েলের নিন্দা করেছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঐক্য পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে মোড় নিতে পারে। ইরান এই সুযোগে আরব দেশগুলোকে নিজেদের দলে টানার চেষ্টা করতে পারে, যা ইসরায়েল এবং আমেরিকার জন্য বিপদজনক।
হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলিদের ফিরিয়ে আনাও এখন আরও কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, কাতারও এর পাল্টা জবাব দিতে পারে। কাতারের বিমানবাহিনীতে রয়েছে ফ্রান্সের তৈরি ৩৬টি রাফাল জেট, ২৪টি ইউরোফাইটার এবং আমেরিকার ৩৫টি এফ-১৫ ইএক্স ইগল যুদ্ধবিমান। এর ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল