আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনে আর কোনো পদোন্নতি দিতে চায় না। নির্বাচনের কর্মযজ্ঞে অনেকটা আটকে গেছে প্রশাসনের যুগ্ম সচিব (রিভিউ) ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি কার্যক্রম। প্রতিনিয়ত পদোন্নতি প্রত্যাশীরা জনপ্রশাসনে ঘুরছেন ভালো খবরের আশায়। কিন্তু জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পদোন্নতি নিয়ে ভালো খবর নেই। নির্বাচনের আগে ভালো খবরের সম্ভাবনাও কম। পদোন্নতিপ্রত্যাশী প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছেন।
পদোন্নতির কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সম্প্রতি বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বাসা) নেতারা মন্ত্রিপরিষদ ও জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে কথা বলেছেন। ১১ নভেম্বর সরকারের শীর্ষ দুই সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাসার সভাপতি গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব মো. নজরুল ইসলাম ও মহাসচিব ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী। মো. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পদোন্নতি নিয়ে আমাদের কর্মকর্তারা চিন্তিত। ২০ ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি ঝুলে আছে। ২৪ ব্যাচের যুগ্ম সচিব না হওয়া বঞ্চিতদের রিভিউর বিষয় আছে। সিনিয়রদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। তারা বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, পদোন্নতির আশায় প্রতিনিয়ত ঘুরছেন ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি নিয়মিত খোঁজ রাখছেন ২০ ব্যাচের কর্মকর্তারা, যারা অতিরিক্ত সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন বহু আগেই। ২০০১ সালের ২ মে ২০ ব্যাচের কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পান। সে হিসেবে যুগ্ম সচিব পদে তাদের পার হয়েছে চার বছর। এই ব্যাচে পদোন্নতির যোগ্য রয়েছেন ২৫৬ কর্মকর্তা। এ ছাড়া বাদ পড়া ইকোনমিক ও অন্যান্য মিলে পদোন্নতির যোগ্য রয়েছেন ৭০ কর্মকর্তা। সব মিলিয়ে ৩২৬ কর্মকর্তাকে পদোন্নতির জন্য বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। জনপ্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, পদোন্নতি দিতে না পারার মূল কারণ হচ্ছে অতীত সরকারের সময় এই ব্যাচের কর্মকর্তারাই বেশি রাতের ভোটে সহযোগিতা করেছিলেন। বিসিএস ২০ ব্যাচের কর্মকর্তারা ২০০১ সালে যোগদান করলেও এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয় আওয়ামী লীগের আমলে। এই নিয়োগে অর্থের বিনিময়ে ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বেশির ভাগই কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মীদের নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। ফলাফল বাতিলের জন্য বঞ্চিতরা পিএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান মোস্তফা চৌধুরীর পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচিও দিয়েছিলেন। বিতর্কিতভাবে নিয়োগের পর গত ১৫ বছর প্রশাসন ক্যাডারকে দলীয়করণে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন এই ব্যাচের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া বিগত ২০১৮ সালের রাতের ভোটের মাঠ প্রশাসনে নেতৃত্ব দেন এই ব্যাচের কর্মকর্তারা। যাদের প্রায় সবাই ওএসডি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, এখনো এ বিষয়ে কোনো খোঁজ নাই। তবে কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুত আছে। সূত্র জানায়, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিতে আরও কয়েক মাস আগেই কর্মকর্তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করে তথ্য সংগ্রহ করেছে সরকার। কর্মকর্তাদের চাকরির রেকর্ড, শৃঙ্খলা তথ্যসহ সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছে। বিগত সময়ে সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীদের পিএস, ডিসির দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে পদোন্নতি দিতে কয়েকটা এসএসবির বৈঠকও হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত আর পদোন্নতি হয়নি। নির্বাচনের আগে আর পদোন্নতির সম্ভাবনা নেই বলেও জানিয়েছে সূত্রগুলো।
অতিরিক্ত সচিবের বর্তমান পদ ৪১৮টি থাকলেও সরকারি কর্মচারী বাতায়ন (জেমস) তথ্য অনুসারে বর্তমানে ৩২৯ জন কর্মকর্তা আছেন। একদিকে যেমন কম আছে তেমনি প্রতিনিয়ত কমছে কর্মকর্তার সংখ্যা। এ কারণে অনেক মন্ত্রণালয়ে, বিভিন্ন দপ্তর/সংস্থার প্রধানের শূন্য পদে উপযুক্ত কর্মকর্তা পদায়ন করতে পারছে না জনপ্রশাসন। এ কারণে অতিরিক্ত সচিবের পদ ফাঁকা আছে অনেক জায়গায়। এদিকে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের মোট কর্মকর্তা ৩৪৪ জন। এর মধ্যে গত মার্চে পদোন্নতি পান ১৯৬ জন। বঞ্চিত হয়েছেন ১৮০ কর্মকর্তা। নিকট-অতীতে এক ব্যাচের এত কর্মকর্তা একসঙ্গে বঞ্চিত থাকার নজির নেই। বিষয়টি নিয়ে বঞ্চিতরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে পদোন্নতি পুনর্বিবেচনার উদ্যোগ নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রায় আট মাসেও কোনো ধরনের ইতিবাচক ফলাফল দৃশ্যমান না হওয়ায় হতাশ তারা। ওই ব্যাচের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন, বাদ পড়া সবাই কি ফ্যাসিবাদের দোসর? তারা পদোন্নতির আশায় নিয়মিত জনপ্রশাসনসহ অন্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে গিয়েও সদুত্তর পাচ্ছেন না। আদৌ কী রিভিউ পদোন্নতি নির্বাচনের আগে হবে কি না, সেটি নিয়ে তাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলেও শান্তি পাচ্ছে না তারা। প্রত্যেক বঞ্চিত কর্মকর্তা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন। তারা অনেকেই বলেন, ‘পরিবার-সমাজের কাছে আমরা লজ্জিত। কারণ অনেকে মনে করছেন আমার কোনো দোষ না থাকলে পদোন্নতি হতো। কেন হয়নি সেটিও কর্তৃপক্ষের জানানো উচিত।’ জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অন্তর্বর্তী সরকার পদোন্নতির ক্ষেত্রে ধীরগতিতে চলাটা স্বাভাবিক। ইতোমধ্যেই পদোন্নতি-পদায়ন নিয়ে নানা সমালোচনা হয়েছে এই সরকারের। তাই হয়তো আর দায় নিতে চায় না। এই সরকারের পদোন্নতির বিষয়টি অগ্রাধিকার কোনো বিষয়ও নয়। সে কারণে আগামীর রাজনৈতিক সরকার সেটি দেখুক, সেটাও হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার চাচ্ছে।