বাংলাদেশে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে চারজনের রক্তে উদ্বেগজনক মাত্রার সিসা পাওয়া গেছে। ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৩৮ শতাংশ এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রায় ৮ শতাংশের দেহেও সিসার মাত্রা নিরাপদ সীমার বেশি। রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতি সবচেয়ে গুরুতর—এখানে আক্রান্তের হার ৬৫ শতাংশেরও বেশি।
রবিবার রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের যৌথ জরিপ এমআইসিএস–২০২৫-এর প্রাথমিক ফলাফলে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এবং ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স উপস্থিত ছিলেন।
প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর ভিত্তি করে করা এমআইসিএস–২০২৫ জরিপে শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুরক্ষা ও বিকাশসংক্রান্ত ১৭২টি মানদণ্ড এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) ২৭টি সূচক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিবিএস জানায়, জরিপের মাধ্যমে বিভাগ, জেলা ও তিন সিটি করপোরেশন পর্যায়ের পরিস্থিতি বিশদভাবে জানা সম্ভব হবে, যা নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্যভিত্তিক হস্তক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে।
পরিসংখ্যান বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার বলেন, এবারের এমআইসিএসে প্রথমবারের মতো অল্পবয়সী শিশু ও গর্ভবতী নারীদের মধ্যে রক্তস্বল্পতা ও ভারী ধাতু দূষণের মাত্রা পরীক্ষার নতুন মডিউল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, সিসা–দূষণ শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য বড় হুমকি। আক্রান্ত শিশুর অর্ধেকেরও বেশি অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের এবং প্রায় ৩০ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের।
ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, “বাল্যবিয়ে ও শিশু মৃত্যুহারে অগ্রগতি দৃশ্যমান। কিন্তু সিসা–দূষণ, শিশুশ্রম এবং বাড়তে থাকা সিজারিয়ান সেকশনের হার লাখো শিশু ও নারীর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।” তিনি জানান, প্রতিটি শিশু যাতে বিকশিত হতে পারে, সে লক্ষ্যে সরকারকে সহায়তা করতে ইউনিসেফ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জরিপে শিশুপুষ্টির অবনতির বিষয়টিও উঠে এসেছে—কম ওজনের শিশুর হার ২০১৯ সালের ৯.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১২.৯ শতাংশে পৌঁছেছে। মায়েদের রক্তস্বল্পতা এখনও অত্যন্ত বেশি—৫২.৮ শতাংশ। কিশোরী জন্মহারও বেড়ে হয়েছে ৯২।
৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শিশুশ্রমের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.২ শতাংশে (২০১৯ সালে ছিল ৬.৮ শতাংশ)। এতে আরও প্রায় ১২ লাখ শিশু নতুন করে ঝুঁকিতে পড়েছে। একই সঙ্গে দেখা গেছে, ৮৬ শতাংশ শিশু সাম্প্রতিক সময়ে কোনো না কোনো ধরনের সহিংস আচরণের শিকার হয়েছে।
বাল্যবিয়ের হার কমে ৪৭ শতাংশে এলেও এখনও প্রায় অর্ধেক মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর হওয়ার আগেই। পাঁচ বছরের নিচের ৫৯ শতাংশ শিশুর জন্ম নিবন্ধন সম্পন্ন হলেও মাত্র ৪৭ শতাংশ শিশুর জন্মসনদ রয়েছে।
জরিপ অনুসারে, নবজাতকের মৃত্যুহার প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মে ২২–এ স্থির রয়েছে, যা পাঁচ বছরের নিচের শিশুদের মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ। দেশের ৭৫ শতাংশ প্রসব এখন সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ব্যয় দুটোই বাড়াচ্ছে।
মাত্র ৪৬ শতাংশ গর্ভবতী নারী প্রথম চার মাসের মধ্যে প্রসব–পূর্ব সেবা নেন, যা মাতৃস্বাস্থ্যসেবার ঘাটতিকে স্পষ্ট করে।
পানি–স্যানিটেশনে বৈষম্য আরও বাড়ছে—স্যানিটেশন সেবায় প্রবেশাধিকার বেড়ে ৭৩ শতাংশ হলেও নিরাপদভাবে ব্যবস্থাপিত পানির হার নেমে গেছে ৩৯.৩ শতাংশে। পানির উৎসের প্রায় অর্ধেক এবং গৃহস্থালির ব্যবহৃত পানির ৮০ শতাংশের বেশি ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়ায় দূষিত।
জলবায়ুজনিত বিপর্যয়ে গত বছর ১০.২ শতাংশ পানির উৎস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা জলবায়ু–সহনশীল অবকাঠামো জরুরিভাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৮০ শতাংশ থাকলেও, উচ্চতর শ্রেণিতে অগ্রগতি ধরে রাখা যাচ্ছে না। অনেক শিশু মৌলিক পড়ালেখার দক্ষতা ছাড়াই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছে এবং ৬ থেকে ৭ শতাংশ শিশু এখনও স্কুলের বাইরে।
এমআইসিএস–২০২৫ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইউনিসেফ সরকারকে শিশু–বিষয়ক নীতিমালা ও বিনিয়োগে সহায়তা করবে বলে জানায়। ইউনিসেফ জরিপে সহযোগিতা করায় সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো–অপারেশন (এসডিসি), যুক্তরাষ্ট্র সরকারসহ বিভিন্ন অংশীজনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
বিডি-প্রতিদিন/সুজন