ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাইফুল ইসলাম (৩২)। পেটে ব্যথা, বমিসহ বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তিনি। সাইফুল বলেন, ‘আমার পরিবারে তিনজনের ডেঙ্গু হয়েছে। বাকিরা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিয়েছে। রামপুরা এলাকায় আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারেই কেউ না কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত
হয়েছেন।’ মৌসুম শেষ হলেও কমেনি ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ। নভেম্বরেও আগ্রাসী রূপে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু। এই মাসের ১৫ দিনেই এডিস মশার কামড়ে ঝড়েছে ৫৩ জনের প্রাণ, আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৩ হাজার ৯৯৬ জন। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুজ্বর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং দুজন ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ৭৯২ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টে যাওয়ায় মশার প্রজনন চক্রও দীর্ঘ হয়েছে। তাই একসময় বর্ষার রোগ হিসেবে পরিচিত ডেঙ্গু এখন সারা বছরের আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মশক নিধনে গতি না থাকায় থামছে না এডিস মশার প্রকোপ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘আগে এডিস মশার প্রাদুর্ভাব মূলত শহর এলাকায় সীমিত থাকত। বর্তমানে নগরায়ণের প্রভাবে এটি গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়েছে। বৃষ্টিপাত, জমে থাকা পানি ও ঝোপজঙ্গলের কারণে গ্রামের মানুষও ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই শুধু শহর নয়, দেশের সব অঞ্চলে সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি।’ তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মশার কিছু ধরনগত পরিবর্তন হয়। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপের ধরনও আগে যেমন ছিল, তা আর প্রযোজ্য নয়। আমরা এখন দেখছি, মশার বিস্তার ও সংক্রমণ দুটোই দ্রুত এবং অনির্ধারিত। ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ বা ধরন রয়েছে। প্রতি বছর একই ধরনের সেরোটাইপে মানুষ আক্রান্ত হয়, এমন নয়। যে কোনো ধরনের ভাইরাসই খুব দ্রুত মিউটেশন বা জেনেটিক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ফলে অনেক সময় শঙ্কাজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ডেঙ্গু নিয়ে গত আগস্টে সারা দেশের হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১০ হাজার ৪৯৬ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয় ৩৯ জনের। সেপ্টেম্বরে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৮৬৬ জনে, মৃত্যু হয় ৭৬ জনের। অক্টোবরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২২ হাজার ৫২০ জনে, মৃত্যু হয় ৮০ জনের।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গুকে মৌসুমি রোগ হিসেবে ভাবলে চলবে না। এটা এখন সারা বছরের সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। মশক নিধন কার্যক্রমে ঘাটতি থাকায় নিয়ন্ত্রণে আসছে না মশা। আমরা এখনো সে কাজটি সঠিকভাবে করতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, শুধু কীটনাশকের ধোঁয়া বা স্প্রে দিয়ে মশার প্রজনন রোধ সম্ভব নয়। মশার প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ শুধু সরকারি দায়িত্ব নয়, প্রত্যেক নাগরিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়।’