‘১০ কোটি টাকা দিয়ে এই চেয়ারে বসেছি, টাকা না দিলে কাজ হবে না।’ ভাবছেন কোনো নাটক বা সিনেমার সংলাপ? একদম না। গুরুত্বপূর্ণ একটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাদের দম্ভের উক্তি এটি। সরকারি অফিসে সেবা নিতে গিয়ে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই। বাংলাদেশে দুর্নীতির একটি বড় কারণ হলো এই বদলি বাণিজ্য। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে একদম নিম্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পছন্দের জায়গায় বদলি হতে হলে টাকা গুনতে হয়। কিছু কিছু লাভজনক পদ বিক্রি হয় কোটি কোটি টাকায়। যে কর্মকর্তা বিপুল অঙ্কের অর্থ দিয়ে বদলি হন, তার প্রথম কাজ হয় বিনিয়োগের টাকা তোলা। এরপর তিনি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত হন।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সচিব থেকে শুরু করে একদম নিম্ন স্তরের কর্মকর্তাদের লাভজনক পদ পেতে ঘুষ দিতে হয়। কর্মচারীদেরও লোভনীয় পদে যেতে উৎকোচ দিতে হয়। সরকারি চাকরিতে কিছু চিহ্নিত পদ আছে যেসব পদে টাকা ছাড়া পদায়ন অসম্ভব। আবার এলাকা ভেদে পদের দাম বাড়ে-কমে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে এরকম অন্তত ২৫টি পদ আছে, যেখানে টাকা ছাড়া বদলি হওয়া সম্ভব নয়। সম্প্রতি এক জরিপে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জরিপে দেখা যায়, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ হলো বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস)-এর ‘প্রাথমিক প্রতিবেদন ২০২৫’-এ এই তথ্য জানানো হয়। এ জরিপটি পরিচালনা করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সময়ে দেশব্যাপী সিপিএস এই জরিপ পরিচালনা করে। বিবিএস জরিপে বলা হয়, সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি বিষয়ে দেখা যায় যে, গত এক বছরে যেসব নাগরিক সরকারি সেবা গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬৭ শতাংশ নাগরিক ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন মর্মে রিপোর্ট করেছেন, যেখানে পুরুষ ৩৮ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং নারী ২২ দশমিক ৭১ শতাংশ। সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নাগরিকদের সর্বাধিক ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো যথাক্রমে বিআরটিএ (৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ), আইন প্রয়োগকারী সংস্থা (৬১ দশমিক ৯৪ শতাংশ), পাসপোর্ট অফিস (৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ) ও ভূমি রেজিস্ট্রি অফিস (৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ)। তবে কিছুটা ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়, টিআইবির নবম থানা জরিপে।
বাংলাদেশে ৭০.৯ শতাংশ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে বলে ওই জরিপে জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। জরিপে অন্তর্ভুক্ত ১৭টি খাত বিবেচনায় শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। পরের দুটি অবস্থানে রয়েছে পাসপোর্ট ও বিআরটিএ। অন্যদিকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত ঘুষদাতা খানার ৭২.১ শতাংশ ঘুষ দেওয়ার কারণ হিসেবে ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’- এ কথা বলেছেন, অর্থাৎ ঘুষ আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অব্যাহত রয়েছে। সার্বিকভাবে খানাপ্রতি গড়ে ৬ হাজার ৬৩৬ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত মোট ঘুষের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ দশমিক ১ কোটি টাকা। সেবা খাতে দুর্নীতি নিয়ে টিআইবি পরিচালিত নবম খানা জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭৪.৪ শতাংশ), পাসপোর্ট (৭০.৫ শতাংশ), বিআরটিএ (৬৮.৩ শতাংশ), বিচারিক সেবা (৫৬.৮ শতাংশ), স্বাস্থ্যসেবা (৪৮.৭ শতাংশ), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (৪৬.৬ শতাংশ) এবং ভূমি সেবা (৪৬.৩ শতাংশ)। এসব প্রতিষ্ঠানে আবার আছে বেশ কিছু লোভনীয় পদ। যেসব পদে আসতে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়।
দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এখানে দুর্নীতি হয় প্রধানত থানাকেন্দ্রিক। অতীতে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকার থানায় ওসি পদে আসতে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা খরচ করতে হতো। এখনো পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি বলেই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু ওসি নন, এসব থানার কনস্টেবল পদে আসতেও গুনতে হয় লাখ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ সদস্য জানান, ঢাকার বাইরে থেকে শুধু ঢাকায় পোস্টিং পেতে পদ ভেদে লাখ টাকা থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়।
একজন পুলিশ সদস্য যখন ঘুষ দিয়ে একটি পদে আসেন তখন তিনি সৎ থাকবেন কীভাবে?
ভূমি অফিসের পদায়ন হলো আরেক ঘুষের খনি। এখানে ঘুষ লেনদেন হয় মূলত সাব-রেজিস্ট্রার পদ ঘিরে। এই সাব-রেজিস্ট্রাররাই হলেন এই খাতের কালেক্টর। জনগণের কাছ থেকে তারাই সরাসরি অর্থ আদায় করেন। এই টাকা পদ অনুযায়ী বণ্টন হয় সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। সাব- রেজিস্ট্রারেরও কিছু নির্দিষ্ট পদ আছে, যেসব বিক্রি হয় রীতিমতো নিলামে। গুলশান, গাজীপুর, রূপগঞ্জ, কেরানীগঞ্জের মতো জায়গায় সাব- রেজিস্ট্রার হিসেবে পদায়নের জন্য লাগে কয়েক কোটি টাকা।
বন বিভাগ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ ইত্যাদি বিভাগে নিম্ন পদের চেয়ে উচ্চ পদ অনেক ব্যয়বহুল। ২০২৩ সালে একটি প্রধান প্রকৌশলীর পদ শতকোটি টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়েছিল। ডাক্তারদের পদায়নেও বাণিজ্য হয়। একজন চিকিৎসককে ঢাকায় বদলি হতে লাখ টাকা গুনতে হয়। এভাবে ঘুষ দিয়ে যখন একজন একটা চেয়ারে বসেন, তখন তার প্রধান এবং একমাত্র লক্ষ্য হয় দুর্নীতি। এভাবেই দুষ্টচক্রে আটকে আছে বাংলাদেশ।